ব্লগ – কাজী নজরুল ইসলাম এর বাণী (জীবন ও প্রেম)

সংকলন – লাবিব মাহফুজ চিশতী

মহাত্মা কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঐশী প্রেমের কবি। আলোকদীপ্ত কবি। হৃদয়ের আলো দিয়ে তিনি নির্মাণ করতে জানতেন সাত আসমান। বিপুল প্রেম আর বিশাল হৃদয় নিয়ে তিনি নৌকা বেয়ে চলেছিলেন জগতের বন্ধুর পথে পথে। আপন খবরের এবারের আয়োজনে থাকছে কাজী নজরুল ইসলাম এর কিছু প্রেরণাপ্রদীপ্ত বাণীর সংকলন।

১. আমার অন্তর আর বাহির যেন এমন একটা অস্বচ্ছ আবরণে চির-আবৃত থাকে যে, কেউ আমার সত্যিকার কান্নারত মূর্তিটি দেখতে না পায়, হাজার চেষ্টাতেও না।

২. যাকে স্নেহ করি, তার অন্যায় টা বুকে সবচেয়ে বেশি বাজে।

৩. মনের অশান্তির আগুন দাবানলের মতো দাউ দাউ করে জ্বলছে। অবশ্য “আমি নিজেই নিজের ব্যথা করি সৃজন”

৪. পায়ে পড়ি আপনাদের, আর আমায় এমন করে ক্ষেপিয়ে তুলবেন না। আমার বেদনা ভরা দূর্ব্বলতার মূল কোথায় জেনে ঠিক সেইখানে কসাই এর মতো ছুরি বসাবেন না। রক্ষা করুন- মুক্তি দেন আপনাদের এই স্নেহের অধিকার হতে।

৫. আগুন, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র, আঘাত, বেদনা- এই অষ্টধাতু দিয়ে আমার জীবন তৈরী হচ্ছে। যা হবে দূর্ভেদ্য, মৃত্যুঞ্জয়, অবিনাশী।

৬. আমি ভালোবাসতে, স্নেত দিতে শিখিয়েছি, কিন্তু ভয় করে ভক্তি করাটা কখনো শিক্ষা দেইনি।

৭. পাওয়ার আনন্দের শান্তির চাইতে, আমি না পাওয়ার আনন্দের অশান্তিকেই কামনা করে আসছি।

৮. আমার আর যাই হোক, কেউ হাত বাড়িয়ে দিলে বুক বাড়িয়ে তাকে আলিঙ্গন করবার উদারতা আমার রক্তের সঙ্গে মেশানো।

৯. এখন আমার আর ভয় নেই, হয় স্বর্গারোহন করবো, নয় একেবারে যে পাঁক থেকে আমি উঠেছি সেই পাঁকেই ডুবে যাবো।

১০. অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিলুম – হয় আগুনে পুড়ে খাঁটি হবো, নয় পুড়ে ছাই হবো। খাঁটি হতে পারলুম না, এখন ছাই হওয়া ছাড়া এ জন্ম থেকে মুক্তি নেই।

১১. মহিমার অচলায়তনে নিঃশ্বাস রোধ করে বেঁচে থাকার মায়া অন্তত আমার ছিল না, কোনোদিন। ও জীবন আমার নয়। নিজেকে হারিয়ে দেওয়া, ছাড়িয়ে দেওয়াই আমার জীবনের গতি।

১২. আমার সত্যকে আমি চেয়েছি এবং পেয়েছিও, এই আমার সান্তনা।

১৩. না; আমাকে পুড়ে খাঁটি হতে হবে।

১৪. আমার এক জায়গায় বড় দুর্ব্বলতা আছে। স্নেহের হাতে আমার মত এমন করে কেউ বুঝি আত্মসমর্পণ করতে পারে না। তাই কেউ স্নেহ করছে বুঝলেই অমনি বাঁধা পড়ার ভয়ে আমি পালিয়ে যেতুম।

১৫. যার ভালবাসায় বিশ্বাস নেই, তার ওপর অভিমান করা চলে না। যাকে বুঝি, আর আমার দাবি আছে যে, এ অভিমান সহ্য করবে, তারই ওপর অভিমান আসে, তারই ওপর রাগ করা যায়।

১৬. বাইরে আমি এতোটা নিষ্করুণ, নির্মম হলেও আমার এই যে মরু ময়দানের শুকনো বালির নিচে ফল্গুধারার মতো অন্তরের বেদনা, তার জন্য করুণায় একটি আঁখিও কি সিক্ত হয় না? এতই অভিশপ্ত-বিড়ম্বিত জীবন আমার।

১৭. আমি উঠেছি বেদনার সিন্ধু মন্থনের শেষ অশ্রু লক্ষীরূপে।

১৮. এই জাগরনের একা জীবন কি দুর্বিষহ বেদনায় ঘায়ে ক্ষত-বিক্ষত, কী নিষ্করুণ শুষ্কতা তিক্ততায় ভরা।

১৯. যে শুক্তি আর কিচ্ছু চায় না, কেবল ছোট্ট একটি মুক্তা হৃদয়ের গোপন কোণে লুকিয়ে থুয়ে অতল সমুদ্রের তলে নিজেকে তলিয়ে দিতে চায়, তাকে তুলে এনে তার বক্ষ চিরে সেই গোপন মুক্তাটা দেখবার এ কী মূঢ় অন্ধ আকাঙ্খা তোমাদের! এ কী নির্দ্দয় কৌতূহল তোমাদের!

২০. মানিক কি কখনো লুকানো যায় রে আহাম্মক! খোশবুকে কি রুমাল চাপা রাখা যায়?

২১. অসীমের সীমা খোঁজায়ম নিরুদ্দেশের চেষ্টায় যে দীর্ঘ অতৃপ্তির আশা আনন্দ, সেই ত আমার উগ্র আকাঙ্ক্ষার রোখ চড়িয়ে দিচ্ছে।

২২. আজ হতে আমি মানব-পরিত্যাক্ত নিখিল-লজ্জিত নর-নারীর দলে।

২৩. বাহিরের ঐর্শ্বর্য্যই তাহার অন্তরের ঐশ্বর্য্য কে আড়াল করিয়া রাখিয়াছে।

২৪. আমি চাই এ বন্ধনের পরে নিঃসীম মুক্তি। মাথায় অনাবৃত আকাশ, চোখের সামনে কূলহারা তটহারা জলধী, মনের সামনে নিরবচ্ছিন্ন অনন্ত একা, একা আমি।

২৫. খোদা, হৃদয়ে বল দাও। বাহুতে শক্তি দাও। আর কর্ত্তব্য-বুদ্ধি উদ্বুদ্ধ করো প্রাণের শিরায় শিরায়।

২৬. নিজের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে যেখানে অন্যায় দেখবো, সেইখানেই আমাদের বজ্রমুষ্ঠির ভীর তরবারীর আঘাত পড়বে।

২৭. আমায় পেতে হলে তোমাকে এই তারারই একটি হতে হবে। আমি নেমে আসতে পারিনে, তোমার আমার পথেই উঠে আসতে হবে।

২৮.পাখির কন্ঠের বিভাস সুর আমার কানে যেনো পূরবীর মত করুণ হয়ে বাজে।

২৯. পাথর কুড়াতে গিয়ে আমি পেয়ে গেছি পরশ মানিক। তাঁর ছোঁয়ায় আমার সকল কাম হয়ে গেছে সোনা।

৩০. ছোট্ট দুটি কথা। ‘সুন্দর’ ও ‘বেদনা’। এই দুটি কথাতে আমি সমস্ত বিশ্বকে উপলব্ধি করতে পারি।

৩১. আমার জন্য যদি আসনই দাও তোমরা, তবে তা যেন বুকের আসন হয় বন্ধু। সভার কোলাহলের নির্ব্বাসন আমি চাই না।

৩২. আমি সাধ করে পথের ভিখারী সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতো ‘ক্ষুদ্র-আত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি।

৩৩. আমার বাণী শিল্পীর বাণী নয়, আমার বাণী বেদনাতুরের কান্না।

৩৪. আর সুরলক্ষী স্বর্গের উর্বশী নয়, মর্ত্ত্যের শকুন্তলা-বিরহ-শীর্ণা অশ্রুমূখী পরিত্যাক্তা শকুন্তলা, উৎপীড়িতা লাইলী।

৩৫. এককালে ধূমকেতুর মতো ঘুরে বেড়িয়েছি বলেই আজ ধ্যান-শান্ত হবার সাধনা করছি- একান্ত নিরালায় সরে গিয়ে।

৩৬. আমি আজো মানুষের প্রতি আস্থা হারাইনি। তাদের হাতের আঘাত যত বড়, যত বেশিই পাই।

৩৭. সকল ব্যথিতের ব্যাথায়, সকল অসহায়ের অশ্রুজলে আমি আমাকে অনুভব করি।

৩৮. ব্যথিতের অশ্রুজলের মুকুরে যেনো আমি আমাকে দেখতে পাই। কিছু করতে যদি নাই পারি, ওদের সাথে প্রাণ ভরে যেনো কাঁদতে পারি।

৩৯. আমি আমার পথের দাবীকে ছাড়বো কেনো? ওদের রাজপথে যদি চলতে নাই দেয়, কাঁটার পথেই চলবো সমস্ত মারকে সহ্য করে।

৪০. কেবলি মনে হচ্ছে, কোন নবলোকের আহবান আমি শুনতে পেয়েছি। পৃথিবীর সুখ বিস্বাদ ঠেকছে যেন।

৪১. সুন্দরের অবহেলা আমি সইতে পারিনে বন্ধু, তাই এত জ্বালা।

৪২. আমার চোখের জলে সকলের চোখের জল এসে মিশেছে। আমার বেদনালোক তীর্থলোকে পরিণত হয়েছে।

৪৩. আমার বাঁশী বিরহ-যমুনার তীরে ফেলে চলে যাব- শুষ্ক যমুনার বালুচর থেকে সেই বেণু কুড়িয়ে যদি অন্য কেউ বাজাতে পারেন, আমার ফেলে যাওয়া বাঁশী ধন্য হবে।

৪৪. যিনি আমাকে বুঝতেই পারেনি, তার পথে বোঝা হয়ে থেকে কোনো লাভ নেই।

৪৫. সুন্দর ও বেদনা- এ দুটি পাতার মাঝখানে একটি ফুল – বিকশিত বিশ্ব। একটি মক্ষী রাণী, তাকে ঘিরেই বিশ্বের মধু-চক্র।

৪৬. আমি বিশ্বাস করি, যে আমায় এমন করে চোখের জলে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সে আমার আজকের নয়, সে আমার জন্ম-জন্মান্তরের, লোক-লোকান্তরের দুঃখ জাগানিয়া।

৪৭. আমার রক্তে রক্তে শেলীকে, কীটসকে এতো করে অনুভব করছি কেনো বলতে পারো?

৪৮. যদি পারো চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্বরণ কোরো।

৪৯. আকাশের সবচেয়ে দূরের যে তারাটির দীপ্তি চোখের জলকণার মতো ঝিলমিল করবে, মনে করো সেই তারাটি আমি। আমার নামে তাঁর নামকরণ করো।

৫০. মৃতুকে এতো করে মনে করি জানো? ওকে আজ আমার সবচেয়ে সুন্দর মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে জীবনে যে আমায় ফিরিয়ে দিলে, মরণে সে আমায় আপন করে নেবে।

সংকলন – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর