কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯–১৯৭৬) বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল ও বহুমাত্রিক প্রতিভা। যাঁকে আমরা বিদ্রোহী কবি, মানবতাবাদী, প্রেমিক ও সাম্যবাদী হিসেবে জানি; কিন্তু তাঁর রচনার আরেকটি গূঢ় ও গভীর দিক হলো তাঁর সুফি সত্ত্বা ও সুফি লেখনী। নজরুলের কবিতা, গান ও প্রবন্ধসমূহে আল্লাহভীতি, প্রেম, আত্মানুসন্ধান, মহব্বত, ওহদতুল উজুদ (তাওহিদের মারেফতি চেতনা), এবং রূহানিয়তের যে প্রবাহ দেখা যায়, তা তাঁকে নিছক একজন সাহিত্যিক থেকে এক অন্তর্মুখী আধ্যাত্মিক সাধকে পরিণত করে। এই প্রবন্ধে আমরা কাজী নজরুল ইসলামের সুফি চেতনার উৎস, তাঁর রচনায় সুফিবাদের উপাদান, রুমী-হাফিজ প্রভাব, ইসলামের মারেফতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের রূহানী প্রবণতা নিয়ে গবেষণাধর্মী আলোচনার চেষ্টা করব।
১. নজরুলের রূহানী বেড়ে ওঠা ও সুফিচেতনার ভিত্তি:
কাজী নজরুল ইসলাম এর শৈশব কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে, এক গরিব কাজি পরিবারে। তাঁর বাবা ছিলেন মসজিদের ইমাম ও মৌলভি। অল্প বয়সেই কোরআন, হাদিস ও ইসলামি সংগীতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। তিনি কাজ করেছেন লেটো গানে, গ্রামীণ কবিগানে—যা সুফি ও বৈষ্ণব ধারার একরকম মিশ্র ছায়া বহন করত। তরুণ বয়সেই তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, যেখানে আরবি-ফারসি সাহিত্যের গভীর পাঠের সুযোগ ঘটে। এখান থেকেই তাঁর রূহানী চেতনার উন্মেষ ঘটে।
কাজী নজরুল ইসলাম এর মানস গঠনে যে আধ্যাত্মিক ছোঁয়া কাজ করেছে, তা তিনি পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন পীর-মাশায়েখদের সাহচর্যে। বিশেষ করে ফকিরি ভাব, দরবেশি গান, এবং চিশতিয়া ও নকশবন্দিয়া মতবাদের আদর্শ তাঁর হৃদয়ে দাগ কেটে যায়।
২. নজরুলের সাহিত্যিক রচনায় সুফি উপাদানসমূহ:
(ক) মারেফতুল্লাহ ও তাওহিদ:
তাঁর অনেক কবিতায় আল্লাহর একত্ববাদের গভীর ধ্যান রয়েছে। এই প্রেম-আল্লাহ সমার্থকতা মূলত ওহদাতুল উজুদ বা একত্ববাদী সুফিবাদের মূল দর্শন। নজরুল তাওহিদকে কেবল বিশ্বাস নয়, বরং আত্মিক অভিজ্ঞতা হিসেবে উপলব্ধি করতেন।
(খ) ইশ্কে হাকিকি (আল্লাহর প্রতি প্রেম):
নজরুলের গানে ও কবিতায় আল্লাহর প্রতি প্রেম, রাসূলের প্রতি ভালোবাসা, এবং আত্মার আকুলতা অত্যন্ত স্পষ্ট।
(গ) রূপক ও প্রতীকের ব্যবহার:
নজরুল ইসলামের সুফি লেখনীতে রূপক উপমা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কবিতায় ‘মায়া’, ‘সুধা’, ‘নূর’, ‘জ্বলন্ত প্রদীপ’, ‘প্রেমশিখা’, ‘ধ্বংস’ – এসব প্রতীক হৃদয়ের ভেতরের তলানিতে ছুঁয়ে যায়।
(ঘ) রূহানিয়াত ও আত্মার মুক্তি:
তাঁর কবিতাগুলো আত্মার মুক্তির দিকেও ইঙ্গিত করে।
এটি একেবারেই মারেফতি দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে আত্মাকে দেহের খাঁচা থেকে মুক্ত করে নূরের উৎসে পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষা থাকে।
৩. নজরুলের গজল ও সুফি সংগীতে চেতনার বহিঃপ্রকাশ:
নজরুল বাংলা সাহিত্যে ইসলামী গজলের প্রবর্তক। তাঁর লেখা প্রায় ৩০০ টিরও বেশি গজল রয়েছে, যেগুলোর ভাষা বাংলা হলেও গঠন ও রস ফারসি-উর্দু সুফি গজলের ধারায় প্রবাহিত। নজরুলের অনেক গজলে রুমি, হাফিজ, ও ওমর খৈয়ামের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তার গজলের ছত্রে ছত্রে আল্লাহর সাথে আত্মার সংলাপ দেখা যায়, যা কেবল ইবাদতের প্রকাশ নয় বরং ধ্যান, মোরাকাবা ও ফানা-মাকামের সুফি দর্শন।
নজরুল তাঁর গানে ‘মুর্শিদ’, ‘পীর’, ‘আল্লাহর নূর’, ‘ফানা’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার করেছেন। তাঁর গান শুধু শোনার জন্য নয়—এগুলো ধ্যানের খাদ্য, আত্মার আহার।
৪. রাসূলপ্রেম ও নূরে মুহাম্মদী চেতনা:
কাজী নজরুল ইসলাম এর লেখায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ছিল আকর্ণ সমর্পিত। এই প্রেম ছিল নিছক ‘নাত’ রচনার আবেগ নয়, বরং ছিল মারেফতি প্রেম – নূরে মুহাম্মদী চেতনায় ডুব দেয়া এক আশেকের আকুতি। নজরুলকে তাই অনেক সুফি আশেকে রাসূল হিসেবেও দেখেন। তাঁর রচনায় রাসূল (সা.)-এর ভালোবাসা ছিল আত্মার মুক্তি ও মারেফতের সোপান।
৫. আত্মা, দেহ ও ফানা-বাকা চেতনা:
সুফিবাদে ‘ফানা’ (আত্মবিলীনতা) ও ‘বাকা’ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়ী অবস্থান) – এই দুইটি স্তর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার উচ্চারণ নিছক কাব্য নয় – বরং এক ধ্রুপদী রূহানী উপলব্ধি, যা ইবনে আরাবি, মাওলানা রুমি ও আল-হাল্লাজের দর্শনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
৬. নজরুল ও রুমি-হাফিজের আধ্যাত্মিক ছায়া:
নজরুল ইসলামের কবিতায় বিশেষভাবে রুমি ও হাফিজের আধ্যাত্মিক চেতনার প্রভাব লক্ষণীয়। রুমির মতোই তিনি প্রেমকে দেখেন স্রষ্টার নিকট পৌঁছাবার পথ। হাফিজের মতন তাঁর অনেক কবিতায় মদ, মদন, সাকি ইত্যাদির ব্যবহার রয়েছে, যা প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে রূহানী আনন্দ, অনন্ত নূর, বা এলাহি ইশকের।
৭. নজরুলের ব্যক্তিত্ব ও জীবনের সুফিপূর্ণ রূপরেখা:
নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী, কিন্তু এই বিদ্রোহ কেবল রাজনৈতিক ছিল না—এটি ছিল আত্মার বিদ্রোহ, জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে ইলমের মশাল। তিনি দুনিয়ার মোহ, হানাহানি ও ভেদাভেদকে ঘৃণা করতেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ওলিদের মতো—জগৎকে দেখো, কিন্তু তাতে ডুবে যেও না। জীবনের শেষভাগে তাঁর নির্জনতা, নীরবতা ও মানসিক নিস্পৃহতা অনেকটাই একজন রূহানী মুজারিদের ছায়া বহন করে।
উপসংহার:
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন শুধু একজন সাহিত্যিক নন—তিনি ছিলেন একজন সুফিসন্ধানী আশেক, যিনি প্রেম, আত্মানুসন্ধান ও তাওহিদের আলোর সন্ধানে ছিলেন আজীবন। তাঁর রচনার গভীরে যে আত্মিক বোধ, যে রূহানী দর্শন, তা আমাদের শেখায়—কবিতা কেবল শব্দ নয়, তা আত্মার কোরআন হতে পারে। তাঁর সৃষ্টির ভেতর দিয়ে বাংলা সাহিত্যে সুফিবাদ এক নতুন রূপে প্রবাহিত হয়েছে, যা তাঁকে “সুফি কাব্যের পথিকৃৎ” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আজকের দুনিয়ায় যখন সাহিত্য দেহমুখী, তখন নজরুলের আত্মিক কাব্য আমাদের রূহানী দিকে ফিরিয়ে নেয়। তাঁর কলম ছিল কেবল প্রতিবাদের না, বরং আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী এক দাওয়াত। তাঁর সুফি লেখনী বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন আকাশ দিয়েছে, যেখানে প্রেম মানে শুধুই ভালোবাসা নয়, বরং আল্লাহর সঙ্গে মিলনের এক নিরব ধারাপাত।