লেখক – মোজাম্মেল হোসেন লুলু
দু’জন কাঠুরিয়া কাঠ কাটার জন্য বনে গেলেন। একজন সকাল থেকে বিরামহীনভাবে কাঠ কাটা শুরু করলেন। অন্যজন কিছুক্ষণ কাঠ কেটে একটু বিশ্রাম নিলেন, আবার কাঠ কাটলেন। কিছুক্ষণ পর খাবার খেয়ে আবার বিশ্রাম নিলেন, তারপর আবারো কাঠ কাটতে শুরু করলেন। প্রথম জন খাবার না খেয়ে, কোনো প্রকার বিশ্রাম না নিয়ে, একটানা কাঠ কাটলেন। বেলাশেষে দেখা গেলো, যে কাঠুরিয়া বিশ্রাম নিয়ে খাবার খেয়ে কাঠ কাটলেন, বিরামহীনভাবে যিনি কাঠ কাটলেন, তার কাঠের ওজন অন্যজনের চাইতে বেশী।
এ ঘটনায় অবাক হয়ে প্রথম কাঠুরিয়া দ্বিতীয় কাঠুরিয়ার কাছে জানতে চাইলেন, “তোমাকে শুধু বসে থাকতে দেখলাম, কাঠ কাটতে দেখলাম কম সময়, আর আমি বিরামহীনভাবে কাঠ কাটলাম কিন্তু তোমার কাঠ বেশী হলো কিভাবে ?” তখন দ্বিতীয় কাঠুরিয়া বললেন, “তুমি কি আমাকে কেবলমাত্র বসে থাকতেই দেখেছো? তুমি কি কখনো দেখনি যে, পরিশ্রম করার ফাঁকে ফাঁকে আমি থেমে কিছুক্ষণ দম নিয়েছি, পাশাপাশি আমি আমার কুড়ালে ধার দিয়েছি। আবার কাঠ কাটার ফাঁকে খাবার খেয়ে নিয়েছি এবং মূহুর্তেই চাঙ্গা হয়েছি।”
আমরা যদি দুই কাঠুরিয়ার এই গল্পের মর্মার্থকে নিগূঢ়ভাবে অনুধাবন করি, তাহলে দেখবো যে, এর মধ্যে আমাদের জন্য মূলবান শিক্ষা রয়েছে। দ্বিতীয় কাঠুরিয়া পরিশ্রম করেছেন কিন্তু ক্লান্ত হননি এবং তার কাটা কাঠের ওজনও প্রথম কাঠুরিয়ার কাটা কাঠের চেয়ে ওজনে অনেক বেশি। প্রথম কাঠুরিয়া শুধুমাত্র কাঠ কাটেননি, ‘সময়দর্শন’কে তিনি নিবিড় মমতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছেন।
অন্য আর একটা গল্প থেকে আমরা আমাদের জীবনের মূলধনের বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, গল্পটি হচ্ছে: এক ব্যক্তি উঁচু পাহাড়ে আরোহণ করে অনেক কষ্ট করে ঐ পাহাড়ের চূড়া থেকে কিছু বরফ সংগ্রহ করে নিয়ে এলেন বাজারে বিক্রি করার জন্য । লোকটি বাজারে বসে আছেন ক্রেতার উদ্দেশ্যে কিন্তু ক্রেতা মিলছে না, ধীরে ধীরে সূর্যের তাপ বাড়ছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সূর্যের তাপে বরফ গলতে শুরু করেছে, এমন সময় লোকটি ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষন করছে-এইভাবে যে, “হে লোকসকল তোমরা কেউ কি আছো! তোমরা কি দেখছো না যে, কোন একজনের মূলধন গলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।”
পৃথিবীতে “বেঁচে থাকা’র সময়টুকুই আমাদের জীবনের মূলধন। যার এই মূলধন ঠিক থাকবে, সে কখনো পরাজিত হবে না, কখনো দুঃখিত হবে না। জীবনের এই মূলধন ঠিক রাখার কাজে যারাই ব্যস্ত, তারাই সত্যিকারের সাধক, তারাই সত্যিকারের ধার্মিক। সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহারকারীগণই সত্যিকারের জ্ঞানী। আর সময়কে সৎপথে এবং সৎকর্মের মাধ্যমে স্রষ্টার সংযোগের নিমিত্তে সাধনার নামই এবাদত বা বন্দেগী। সুফী সাধকগণ উপলব্ধি করেছেন যে, “সময়দর্শনই জীবনদর্শনের প্রথম সোপান।” আর এ জন্যই মরমী সাধক বাবা লালন শাহ্ ফকির তার গানে বলেছেন, ‘সময় গেলে সাধন হবেনা’।
একশ্রেণীর মানুষ পরকালে বেহেশতে যাওয়ার জন্য ‘ধর্মকর্ম’ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সারাক্ষণ। অর্থাৎ একশ্রেণীর মানুষ সত্যিকারভাবে আল্লাহকে পাওয়ার জন্য নয়, কেবলমাত্র পারলৌকিক মুক্তির ‘লোভ’ এর কারণে সারাক্ষণ ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন । অর্থাৎ তারা নিজের জন্যেই সারাক্ষণ ব্যস্ত। তারা এক ধরনের আত্মকেন্দ্রিকতার মধ্যে, বিভ্রান্তির মধ্যে ডুবে আছেন। আত্মকেন্দ্রিকতা নিয়ে জীবনদর্শনের পথে কখনই যাওয়া যায় না। আর এজন্যই সাধকরা মনে করেন, “আত্মদর্শনই জীবনদর্শনের দ্বিতীয় সোপান।”
কোরআনকে যদি আমরা দুইভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তবে তা আমাদের জন্য বুঝতে সহজ হয়ে যাবে। অর্থাৎ মূল কোরআন আর কপি কোরআন। মূল কোরআন অবশ্যই জ্ঞানীদের জন্য। আর কপি কোরআন থেকেই মূল কোরআনের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন মাজিদের সূরা ওয়াকিয়া’র ৭৭-৭৯ নম্বর আয়াতে কোরআন নিজেই নিজের পরিচয় ব্যক্ত করেছে: “ উহা লৌহ মাহফুজে সুরক্ষিত রয়েছে, আর পূতঃ পবিত্রতা ছাড়া কেউ তা স্পর্শ করতে পারে না”।
যিনি কপি কোরআন সঠিকভাবে বুঝবেন, তার জন্য নিঃসন্দেহে মূল কোরআনের সন্ধান পাওয়ার পথ সহজ হয়ে যাবে। কোরআনের মধ্যেই বলা আছে, কোরআনে: “জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় নিদর্শন রয়েছে।” যদি কোরআন জ্ঞানীদের জন্য্ই হয়ে থাকে, তবে আগে নিজেকে অবশ্যই সত্যিকারের জ্ঞানী হতে হবে। আর জ্ঞানী হতে হলে একজন জ্ঞানীর কাছেই যেতে হবে এবং এইরূপ জ্ঞানীই হবেন সম্যক পথ নির্দেশক ও সম্যক দিক নির্দেশক ’। আর তিনিই হবেন কোরআনের সত্যিকার নিদর্শন। এমন একজন ‘জ্ঞানী’র সঙ্গে ‘সম্মিলন’ ঘটলেই অহর্নিশি ‘জ্ঞান’ আসতে থাকবে নিজ ভান্ডারে।
আর এজন্যেই সুফী সাধকগণ বলেন, “যিনি জ্ঞান কান্ডারী, তিনিই হবেন জ্ঞান ভান্ডারী।” যিনি জ্ঞানভান্ডারী তিনিই সত্যদর্শনের পথে থাকবেন, আর সত্যদর্শনই জীবনদর্শনের চূড়ান্ত সোপান। প্রকৃত জ্ঞানীর নির্দেশ মেনে সময়কে সৎকর্মে ব্যয় করাই সময়দর্শন, আত্মদর্শন ও সত্যদর্শনের একমাত্র পথ। আর এটাই সত্যিকারের জীবনদর্শন, এটাই সত্যিকারের রিয়াজতী সাধনা, এটাই সত্যিকারের বন্দেগী।