লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
একটা গল্প শোনাই। বহুদিন আগের। একজন সুফির ব্যক্তিত্ব কেমন হতে পারে, তার কিছুটা ধারণা পাবেন। আর প্রকৃত সুফি ও বেশধারী ভন্ড সুফির তফাতটাও ধরতে পারবেন।
মিয়াঁ মীর নামের এক সাধক ছিলেন লাহোরের ধর্মপুরায়। কাদরিয়া তরিকার অন্তর্গত মিয়াঁ খেল উপতরিকার প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তিনি মুঘল সম্রাট শাজাহানের জ্যোষ্ঠপূত্র দারাশিকোহর গুরু ছিলেন।
সাধক মিয়াঁ মীর লাহোরে থাকাকালীন তাঁর দরবারে প্রহরী নিযুক্ত করেছিলেন, যাতে দুনিয়াদার, প্রতাপশালী বা বিত্তবান লোকেরা তাঁর নিকট যেতে না পারে, বিরক্ত করতে না পারে।
মুঘল সম্রাট সেলিম জাহাঙ্গীর একবার সৈন্য-সামন্ত, পরিষদবর্গ নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হলেন মিয়াঁ মীরের দরবারে। দরবারের প্রবেশমুখেই বাধাপ্রাপ্ত হলেন প্রহরীর নিকট। প্রবেশের অনুমতি নেই! বাদশাহকে ফটকে দাঁড় করিয়ে রাখা হল বহুক্ষণ! তার নিজের রাজত্বে এতোটা অপমানিত তিনি কখনো হননি!
অবশেষে মিলল অনুমতি। বাদশাহকে নিয়ে যাওয়া হল মিয়াঁ মীরের নিকট। বেশ কিছু দরবেশ ও সাধক সমভিব্যাহারে উপবিষ্ট ছিলেন মিয়াঁ মীর। দরবারে প্রবেশ করেই কিছুটা দাম্ভিকতার সাথে মিয়াঁ মীরকে লক্ষ্য করে বাদশাহ বললেন,
“বা দার-এ-দারবিস দরবানে না-বায়দ”
ফকিরের দরজায়, কোনও প্রহরী থাকা উচিত নয়।
মিয়াঁ মীরের উত্তর ছিল –
“বাবাইদ কেহ সেজে দুনিয়া না আয়দ”
প্রহরী রাখি যাতে দুনিয়াদার লোকেরা প্রবেশ করতে না পারে!
লজ্জিত হলেন বাদশাহ। ক্ষমা প্রার্থনা করে দোয়া চাইলেন। দাক্ষিণাত্য অভিযানের পরিকল্পনা করেছেন তিনি। অভিযানে সফলতার জন্য দোয়া করতে বললেন সাধক মিয়াঁ মীর কে।
এমন সময় এক ভক্ত দরবারে উপস্থিত হয়ে মিয়াঁ মীরকে ভক্তি জানিয়ে এক টাকা নজরানা দিলেন। মিয়াঁ মীর খাদেমকে বললেন, এখানে উপস্থিত লোকেদের মধ্য থেকে সবচেয়ে অভাবী ব্যক্তিটিকে টাকাটা দান করে দাও।
দরবেশদের মধ্য হতে কেউই টাকাটা গ্রহণ করলেন না। টাকা হাতে মিয়াঁ মীরের নিকট ফিরে এলেন খাদেম। তখন মিয়াঁ মীর বাদশাহের দিকে ইঙ্গিত করে খাদেমকে বললেন, টাকাটা ওকে দিয়ে দাও!
আমাদের মধ্যে সে সবচেয়ে দরিদ্র এবং সবচেয়ে অভাবী। বিশাল রাজ্যে সন্তুষ্ট নয়, সে আবার দাক্ষিণাত্যের রাজ্যের লোভে দিল্লি থেকে এখানে ভিক্ষা করতে এসেছে। তার সর্বগ্রাসী ক্ষুধা যেন জলন্ত অগ্নি যা শুকনো কাঠকে নির্মমভাবে জ্বালিয়ে দেয়। এ লোভ তাকে আরো অভাবী, দরিদ্র ও কৃপণ করে তুলেছে। যাও, টাকাটা ওকেই দিয়ে দাও!
আজকের সুফিদের জন্য শিক্ষাটা সবচেয়ে জরুরী! মেরুদন্ডশুণ্য মেকী সুফিদের জন্য আজ সমগ্র সুফিসমাজ কলঙ্কিত। সুফিরা বাদশাহের বাদশাহ। দুনিয়া তাদের পদতলে। ঐশ্বর্য, ক্ষমতা, বৈভব তাদের কাছে ঘৃনার বস্ত।
আদর্শ পরিত্যাগ করে যখনি সুফিরা বিত্ত আর ক্ষমতার পায়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে, তখন থেকেই শুরু হয়েছে সুফিদের পদস্খলন। এ পদস্খলন থেকে উত্তরণের জন্য আমাদেরকে প্রকৃত সুফি হতে হবে। নির্মোহ, বীর্যবান হতে হবে। ত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখাতে হবে।
মাওলা আমাদের সুফি আদর্শের মাঝে সমুন্নত থাকার সামর্থ্য দিন।
আমিন।
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
সম্পাদক – আপন খবর পত্রিকা
চেয়ারম্যান – আপন ফাউন্ডেশন