সংকলন – লাবিব মাহফুজ চিশতী
হযরত হারেস আল-মুহাসেবী (রহ.) ছিলেন নবম শতাব্দীর একজন প্রখ্যাত সুফি, আলেম ও আত্মশুদ্ধির অগ্রদূত। তাঁর পূর্ণ নাম ছিল আবু আবদুল্লাহ হারেস ইবনে আসাদ আল-মুহাসেবী, এবং তিনি বসরায় জন্মগ্রহণ করলেও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন বাগদাদে। তিনি “মুহাসেবী” উপাধি লাভ করেন নিজের আত্মসমালোচনার (মুহাসাবা) প্রবণতার কারণে—অর্থাৎ প্রতিনিয়ত নিজের চিন্তা, কথা ও কাজকে আল্লাহর আলোকে পর্যালোচনা করতেন।
তিনি ছিলেন ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর সমসাময়িক এবং ইমাম জুনায়দ বাগদাদী (রহ.)-এর শিক্ষকের শিক্ষক। হযরত মুহাসেবী (রহ.) ইসলামি মনোবিজ্ঞান, আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনকে যুক্তিবাদ ও কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ “আল-রিআইয়া লি হুকূকিল্লাহ” (আল্লাহর অধিকারের রক্ষণাবেক্ষণ) তাসাওউফের ইতিহাসে এক ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত।
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি নিজেকে জানে, সে তার রবকে চিনে। আর যে তার অন্তরের রোগ চেনে, সে নিজের চিকিৎসাও খুঁজে পায়।” তাঁর শিক্ষা ছিল গম্ভীর, গভীর ও আত্মজাগরণমূলক। হারেস মোহাসেবী (রহ.)-এর অবদান তাসাওউফ-কে একটি জ্ঞানের শৃঙ্খলা হিসেবে গঠন করতে অনন্য ভূমিকা রেখেছে।
তাঁর অসামান্য কিছু বাণী মুবারক –
1. সত্য হোক বা মিথ্যা হোক, কোনো বিষয়ে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আল্লাহর নামে কোনো শপথ কোরো না।
2. মিথ্যা পরিহার করো।
3. প্রতিজ্ঞা করা ভালো না। করলে তা পূর্ণ করো।
4. কেউ জুলুম করলে তাকে অভিশাপ দিও না। প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা কোরো না। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে ধৈর্যধারণ করো।
5. মুশরেক মুনাফেক বলে কারো নামে সাক্ষ্য দিও না।
6. প্রকাশ্যে বা গোপনে কখনোই পাপ চিন্তা কোরো না। নিজের প্রবৃত্তিকে পাপ থেকে বিরত রাখো।
7. নিজের কষ্টের বোঝা নিজেই বহন করো। অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিও না।
8. লোভ দমন করে পুরোপুরি নির্লোভ হও।
9. আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে কিছু আশা কোরো না।
10. উচ্চ আসন খুঁজতে যেওনা। তোমার চেয়ে কাওকে হেয় বা ছোট ভাবতে যেওনা।
11. আল্লাহর নির্দেশ পালনই হল আল্লাহর সন্তুষ্টি।
12. বিপদে অধৈর্য না হওয়াই জ্ঞানীর লক্ষন।
13. যার প্রতি আল্লাহ নারাজ, তার থেকে দূরে থাকাই হল শরম।
14. কোন কিছুর প্রতি প্রেম প্রীতি অক্ষুন্ন রেখে, তার উদ্দেশ্যে নিজের ধন প্রাণ উৎসর্গ করে ভেতরে বাহিরে তার সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখাই হল মহব্বত।
15. যে কাজের ফলে রোজ কেয়ামতে শাস্তি বা ভয়ের আশঙ্কা আছে তা থেকে বিরত থাকাই হল ভয়ের লক্ষন।
16. নির্জন সাধনায় যে হৃদয় সুখানুভব করে, সে হৃদয়ে আল্লাহর প্রেম বিদ্যমান আর পৃথীবির প্রেম শূণ্য। এ ধরণের লোক হল আল্লাহর প্রকৃত প্রেমিক।
17. নির্জনে আল্লাহর উপাসনা করা ও যে বস্তুর সাথে বিষয়ী লোক জড়িত তা দূরে থাকাই হল আল্লাহপ্রেম।
আরো কিছু বাণী –
১. যে নিজের আমলকে ভালো মনে করে, সে আল্লাহর কাছে তুচ্ছ; আর যে নিজের আমলকে তুচ্ছ মনে করে, সে আল্লাহর কাছে সম্মানিত।
২. সৎ নিয়ত ছাড়া কোনো আমলই আল্লাহর কাছে গৃহীত হয় না—যদিও তা বাহ্যিকভাবে খুবই সুন্দর হয়।
৩. তুমি যদি নিজের অন্তরকে শুদ্ধ না করো, তবে বাহ্যিক ইবাদত তোমাকে কেবল ধোঁকায় রাখবে।
৪. আত্মসমালোচনার চর্চা করো, কারণ যেদিন হিসাব নেয়া হবে, সেদিন নিজেকে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকবে না।
৫. যে আল্লাহর ভয় অন্তরে রাখে, তার চেহারায় অহংকার থাকে না, মুখে গর্ব থাকে না, হৃদয়ে হিংসা থাকে না।
৬. যখন অন্তর আল্লাহর প্রেমে পরিপূর্ণ হয়, তখন তা দুনিয়ার সবকিছুকে হালকা মনে করে।
৭. মুমিন ব্যক্তি তিনটি জিনিসে কখনো তৃপ্ত হয় না—ইলম, ইবাদত ও কান্না।
মাওলা আমাদেরকে সত্য ও সুপথ প্রদর্শন করুন। আমীন।