লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
ইয়া মাওলা আলী (আ.)
বিদায় হজ্ব সম্পন্ন করে রসুলে কারীম (সা.) প্রায় সোয়া লক্ষ সাহাবী সমভিব্যাহারে এহরামের পোষাক পরিহিত অবস্থায়ই মদিনার দিকে রওনা হলেন। দিনটি ছিল ১৮ জিলহজ্ব। পথে গাদীরে খুম নামক স্থানে উপস্থিত হলে রাসুল করীম (সা.) এর ওপর নাযিল হয় –
হে রাসুল, আপনার রবের পক্ষ হতে আপনার প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দিন। আর যদি তা পৌঁছে না দেন, তাহলে রেসালাত পৌঁছানো হল না। (৫:৬৭)
আয়াত নাযিল হওয়ামাত্র রাসুলে পাক (সা.) সকলকে ঐ স্থানেই (গাদীরে খুম) একত্র করে রবের নির্দেশিত রেসালাত পৌঁছে দেবার জন্য মঞ্চ সাজাইলেন। উটের পিঠে বসার অনেকগুলো আসন একত্র করে স্থানটি উঁচু করে তার উপরে উঠে রসুলে পাক (সা.) ঘোষণা দিলেন-
আমি কি তোমাদের জীবন হতে অধিক প্রিয় এবং অধিকার প্রাপ্ত নই?
উপস্থিত সকল সাহাবী সমবেত কন্ঠে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ইয়া রাসুলাল্লাহ।
উপস্থিত জনতামন্ডলী হতে এই স্বীকৃতি লাভ করে রাসুলে পাক (সা.) মাওলা আলী (আ.) কে সেই মঞ্চে দু-বাহু ধরে উঁচু করে তুলে ধরলেন এবং উচ্চারণ করলেন মাওলাইয়াতের সেই অমোঘ ঘোষণা :
মান কুনতুম মাওলাহু, ফাহাজা আলীউন মাওলা।
আমি যার মাওলা, আলী তার মাওলা। হে আল্লাহ, তুমি তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো যে আলীকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তুমি তাকে শত্রুরূপে গ্রহণ করো যে আলীর সাথে শত্রুতা করে, সাহায্য করো তাকে যে আলীকে সাহায্য করে এবং লাঞ্ছনা দাও তাকে যে লাঞ্ছনা দেয় আলীকে।
মাওলাইয়াতের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনতামন্ডলীর মধ্যে ধন্য ধন্য রব উঠে গেল। সকল সাহাবী ক্রমে নবনিযুক্ত মাওলা ও ইমাম আমীরুল মুমিনিন মাওলা আলী (আ.) এর পবিত্র হাত মোবারকে হাত রেখে বাইয়াত তথা আনুগত্য গ্রহণ করলেন। বাইয়াত গ্রহণ শেষ হলেই রাসুলে পাক (সা.) এর নিকট নাযিল হল কুরআনের সর্বশেষ আয়াতটি।
আজ তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা দান করলাম এবং তোমাদের দ্বীন ইসলামের প্রতি আমি রাজি হইলাম। (৫:৩)
দ্বীন পূর্নতার ঘোষণাপ্রাপ্তির আনন্দে রাসুলে পাক (সা.) রবের দরবারে কৃতজ্ঞতা জানালেন এই বলে –
আল্লাহ মহান। সমস্ত প্রশংসা তাঁর দ্বীনকে পূর্ণ করার জন্য ও নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দেয়ার জন্য, আমার রেসালাতের ওপর সন্তুষ্টির জন্য এবং আবু তালিব নন্দন আলীর বেলায়েতের জন্য।
রাসুলে খোদা (সা.) বলেন – আমি যার মাওলা আলী তার মাওলা।
(তাফসীরে কবীর, তাফসীরে দুররে মনসুর, তাফসীরে রুহুল মাআনী, তাফসীরে মাজহারী, তাফসীরে সালাবী, তিরমিজি, ফতহুল কাদীর, আস সুনান, আল মুসান্নাফ, আল মুসনাদ, তারিখুল কবীর)
উমর ইবনুল খাত্তাব হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলীর ন্যায় এত বেশি মর্যাদা কেউ অর্জন করতে পারেনি। আলীর পদাঙ্ক অনুসরণকারীরা হেদায়েতপ্রাপ্ত। (আর রিয়াজুন নাদেরা, আল মুস্তাদরাক, সাওয়ায়েকে মুহরিক, নুরুল আবসার, তারিখে বাগদাদ, সীরাতে হালাবী)
রসুলে খোদা (সা.) বলেন, আমি ও আলী একই নূরের দু টুকরো। আমি ও আলী একই নূর হতে সৃষ্টি।
(ফাজায়েলে সাহাবা, বিয়াজুন নাদেরা, ইয়ানাবিউল মুয়াদ্দাহ, সুয়ুফুল মুশরিকাত, তাফসীরে রুহুল মাআনী, তারিখে বাগদাদ)
নবী ও আলী একই বংশ।
(সাওয়ায়েকে মুহরিকা, মাজমাউল যাওয়ায়েদ, জামেউল কবীর, আল মুস্তাদারাক, মুসনাদে ফিরদাউস, কানজুল উম্মাল, তারিখে দামেস্ক, নাইলুল আওতার)
রসুলে খোদা (সা.) বলেন, আমি হিকমতের শহর, আলী তার দরোজা।
(আল মুজামুল কবীর, আল মুস্তাদরাক, জামেউস সগীর, কানজুল উম্মাল, জামেউল কবীর, ফাজায়েলে সাহাবা, আল জামে, হিলিয়াতুল আউলিয়া, আল মানাকিব, ফতহুল কবীর, সাওয়ায়েকে মুহরিকা, শাওয়াহেদুত তানজিল)
রসুলে খোদা (সা.) এর একমাত্র উত্তরাধিকারী হলেন মাওলা আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)
(কানজুল উম্মাল, তারিখে তাবারী, তারিখে দামেস্ক, মুসনাদে ফিরদাউস, ফতহুল বারী, রিয়াজুন নাদেরা, আল মুস্তাদরাক)
মাওলা আলী (আ.) এর প্রতি ভালোবাসার দ্বারাই মুনাফেক ও মুমিনের পার্থক্য নিরূপিত হয়।
(আস সুনান, আল মুসনাদ, ফাজায়েলে সাহাবা, সুনানে কুবরা, আল মুজাম, শরহে মাজাহিব, আল ঈমান, শরহে সুন্নাহ, আল মুসান্নাফ, আল ইতেকাদ, মানাকিবে আলী)
কোরআন ও আলী পরস্পর অবিচ্ছিন্ন।
(আল মুজামুল আওসাত, আল মুজামুস সাগীর, আল মুস্তাদরাক, কানজুল উম্মাল, তারিখুল খুলাফা, ফতহুল কবীর, ফয়জুল কাদীর)
মাওলা আলী (আ.) স্বয়ং জান্নাত ও জাহান্নামের বন্টনকারী।
(আরশিফু মুলতাকা আহলিল হাদিস, ফারায়েদুস সিমতাঈন, মানাকিবে আলী, ইয়ানাবিউল মুয়াদ্দাহ, মুসনাদে ফিরদাউস, জামেউল কবীর, কানজুল উম্মাল)
গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.) বলেন, সমুদ্রকে যেমন ঘটিতে ধারণ করা সম্ভব নয়, তেমনি বর্ণনার মাধ্যমে মাওলা আলী (আ.) এর গুণাবলী তুলে ধরাও সম্ভব নয়।
মাওলা আলী (আ.) এর তিনটি পবিত্র উক্তি :
১. বুদ্ধিমত্তা সর্বোত্তম সম্পদ, মূর্খতা সবচাইতে বড় দুস্থতা, আত্মগর্ব সবচাইতে বড় বর্ববরতা ও নৈতিক চরিত্র সর্বোত্তম অবদান।
২. হীনতম জ্ঞান জিহ্বায় থাকে এবং উচ্চমানের জ্ঞান কর্মের মাঝে প্রকাশ পায়।
৩. আহলে বাইতকে যারা ভালোবাসে তাদেরকে অনেক দুঃখ-দুর্দশা-লাঞ্ছনা-উৎপীড়ন-যন্ত্রণা পোহাবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে