প্রবন্ধ – দ্বীনে মোহাম্মদীর ফল্গুধারা

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

দ্বীনে মোহাম্মদীর শ্বাশত নূরের ফোঁয়াড়া আরবের কন্টক সমাকীর্ণ তপ্ত মরুপথে অঙ্কুরিত হয়েই তথাকার বৈরী পরিবেশে ক্ষণকালেই মুমূর্ষ হয়ে পরে। আরবের প্রচলিত কুসংস্কার, যাযাবর জনগোষ্ঠীর একগুয়েমী ও অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে এবং বিশেষ করে নবী (সাঃ) এবং তাঁর বংশধরদের চিরশত্রু যারা, তারাই পরবর্তীতে ধর্মীয় নেতৃত্ব লাভ করার ফলে দ্রুতই প্রকৃত ধর্ম নির্বাসিত হয় আরব থেকে। আরব জনগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক বৈরিতা ও ধর্মবোধে অনীহার ফলশ্রুতিতে ধর্মবিদ্বেষীরাই হয়ে উঠে ধর্মের হর্তাকর্তা! তাদের নেতৃত্বেই চালিত হতে থাকে তাদের দ্বারা প্রচুর কাস্টমাইজ করা এক উদ্ভট কিম্ভুতকিমাকার ধর্ম, তাও আবার দ্বীন ইসলামের নামে!

নবী করিম (সাঃ) দেহান্তরে গমন করার অব্যবহিত পর থেকেই শুরু হয় এ ধর্মনাশের বিচিত্র মহড়া! আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধি কে তথা মাওলাইয়াত কে অস্বীকার করে, মনুষ্য দ্বারা প্রোপাগান্ডা মূলক নিবার্চনের মাধ্যমে যখনই ধর্মীয় নেতৃত্বে আসীন হলো আহলে বাইয়্যেত বহির্ভূত ক্ষমতাশালী চক্র, তখন থেকেই মূলত ধর্মবিনাশের জোর তৎপরতা শুরু হলো। আল্লাহ ও রাসুল মনোনীত মাওলাইয়াতের বদলে মনুষ্য নির্বাচিত খেলাফতই দ্বীনে মোহাম্মদীর ভিতকে সমূলে উৎপাটন করার প্রথম এবং স্বার্থক উদ্যোগ। খেলাফতের শুরুতেই নূর মোহাম্মদ (সাঃ) কে মৃত ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে শ্বাশত ধর্মবিধানের বুকে কুঠারাঘাত করা হলো।

দ্বীনে মোহাম্মদীর একমাত্র উত্তরাধিকারী এবং মনোনীত ইমাম মাওলা আলী (আ), মা ফাতেমাতুজ্জাহরা (আ), মাওলা ইমাম হাসান (আ), মাওলা ইমাম হোসাঈন (আ) কে সকল দিক হতে বঞ্চিতকরণের অপপ্রয়াস এবং তাদেরকে অত্যাচার নির্যাতনের মাধ্যমে মজবুত করা হলো অবৈধ খেলাফতের ভিতকে। একের পর এক পূর্বসূরীর মনোনয়নের মাধ্যমে চলতে থাকলো খেলাফতি মিশন। দ্বীনে মোহাম্মদীর প্রকৃত রূপ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকলো। দ্বীনে মোহাম্মদীর কবর রচনা করার সবচাইতে মোক্ষম কর্মটি সাধিত হলো নবীবংশের চিরশত্রু উমাইয়াদের রাজক্ষমতায়নের মাধ্যমে। যার ফলশ্রুতিতেই নির্বাহ হলো পরবর্তীতে আহলে বাইয়্যেত এর প্রতি নির্মম অত্যচারের ও হত্যার ঘটনাবলী।

খেলাফতি শাসনামলে ধর্মবিরোধী অপতৎপরতা এতোটাই প্রসারিত হয়েছে, যদিও জনগণের চাপে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে বাধ্য হলেন মাওলা আলী (আ), অব্যবহিত পরেই গুপ্তঘাতকের হাতে দেহত্যাগ করতে হলো তাঁকে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারেই এগোতে থাকলো ধর্মনাশের সকল কার্যক্রম। মুয়াবিয়ার শাসনকালে অতিকষ্টে বেঁচে থাকা অবশিষ্ট দ্বীন মোহাম্মদীর ওপর দিয়ে বয়ে গেলো ভয়ঙ্কর সাইমুম ঝড়। মুয়াবিয়ার বিস্তর অপকর্মের দরুণ এবং ধর্মবিরুদ্ধ কার্যকলাপের দরুণ মুমূর্ষ ধর্ম শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে বাধ্য হলো। কারবালায় দ্বীন মোহাম্মদীকে দাফন করলো তারই গুণধর পুত্র এজিদ।

দ্বীনে মোহাম্মদীর শ্বাশত জ্যোর্তিচ্ছটা শেষ হয়ে যাবার নয়। অপশক্তির হাতে নির্মূল হবার নয়। নবীপ্রেমিক কিছু কিছু মানুষ হৃদয়ে ধারণ করে রাখলেন সে অনির্বাণ জ্যোতি। যদিও পদে পদে সে মানুষগুলো হয়েছেন অপদস্থ, হয়েছেন ক্ষমতাশালীদের নিগ্রহের শিকার, হত্যা করা হয়েছে তাদের, বাধ্য করা হয়েছে দেশত্যাগে। রাষ্ট্রলোভীদের হাতে বার বার গণহত্যার শিকার হয়েছেন তাঁরা। তবুও অতি যত্নে আগলে রেখেছেন দ্বীনে মোহাম্মদীর আলোকধারা। পরম মমতায় সংরক্ষণ করেছেন মাওলা মুহাম্মদ (সা) হতে মাওলা আলী (আ) এর মাধ্যমে প্রাপ্ত গুপ্তজ্ঞানের নহর। হৃদয়ে চির জাগুরুক রেখেছেন নবীপ্রেমের স্বর্গসুধা। এই পরম ভক্তশ্রেণী তথা প্রকৃত ধার্মিকগণ রাজশক্তির কোপানল থেকে জিবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়িয়েছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। তাঁরাই দ্বীনে মোহাম্মদীর দীপ্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন জগতের কোনায় কোনায়।

আরব থেকে চরম লাঞ্ছিত, নিগৃহীত ও নির্যাতিত হয়ে দ্বীনে মোহাম্মদী তথা নবীপ্রেম তথা আহলে বাইয়্যেত এর ভালোবাসা বুকে নিয়ে কিছু পরম ভক্ত তথা ধার্মিক তিলে তিলে জেগে রইলেন জগতের কোথাও কোথাও। তাঁদের থেকেই জগতের আবাদ হচ্ছে প্রকৃত ধর্ম। দ্বীনে মোহাম্মদী। তাদের থেকে সিনা-ব-সিনা জগতের বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে ইলমে মারেফতের ফল্গুধারা।

দ্বীনে মোহাম্মদীর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী মরুঝড়ের নাম সালাফিবাদ। ইঙ্গ-মার্কিন অপরাজনীতি তথা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ এর কবলে পরে এবং মুর্খ গোঁড়া সৌদি রাজতন্ত্রের পেট্রোডলারের রাজনীতির ফলশ্রুতিতে সৌদিতে দ্বীনে মোহাম্মদী ধ্বংসের উপায় হিসেবে আমদানি করা হয় ওহাবীবাদ বা সালাফীবাদকে। যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম পরিগ্রহ দ্বীনে মোহাম্মদীকে ধ্বংসের বিভিন্ন ফাঁদ রচনা করে চলেছে। এক্সট্রা পিউরিটান প্রবণতার নামে এই ফাঁকা অক্ষরবাদী তথা খোলসসর্বস্ব/আচারসর্বস্ব ধর্মনীতি দ্বীনে মোহাম্মদীর বিরুদ্ধে দাঁড় করানো এক অতিমারী অস্ত্র ব্যতিত আর কিছুই নয়। আমাদের দেশে এই অপনীতি দেওবন্দী মতবাদ নামে সমধিক পরিচিত। যদিও তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম ধারন করে তাদের কুকর্ম কুতৎপরতার প্রকাশ বিকাশ ঘটিয়ে থাকে।

যুগে যুগে মুষ্টিমেয় ধার্মিকদের বিপক্ষে অধার্মিক বা অসুরশক্তির তীব্রতা ছিল ভয়াবহ। তাদের বিস্তর অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে তবুও ধুঁকে ধুঁকে কিছু প্রাণ জগতের বুকে বাঁচিয়ে রাখে চির সত্যের দেশনাকে। তারাই ধর্মের ধারক বাহক। তারাই গুরু মুর্শিদ, ওলী আউলিয়া। তাদের শরণেই ধর্মের পালন হয়।

“নবীপ্রেম তথা আহলে বাইয়্যেত এর প্রতি প্রাণাধিক ভালোবাসা তথা গুরু মুর্শিদ বা অলী আউলিয়াদের প্রতি প্রাণাধিক ভালোবাসা ও পূর্ণ আনুগত্য অনুসরণ এর মাধ্যমেই দাখিল হওয়া সম্ভব সেই প্রকৃত দ্বীনে মোহাম্মদীতে।”
সকল বিঘ্ন অতিক্রম করে মুষ্টিমেয় কিছু পবিত্র ও জ্ঞানী মানুষের সিনায় সিনায় ফল্গুধারার মতো জারি থাকবে দ্বীনে মোহাম্মদীর আলোকপ্রবাহ। সে শ্বাশত নূরের ধারায় নিজেকে শামিল করাই প্রকৃত মুসলমানের কাজ।

রচনাকাল – 12/11/2017
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর