পত্রিকা – একটি গানের তাফসির – ৫ম সংখ্যা ২য় পর্ব

হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী

সত্যিকারের সুন্নি আলেমগণ ছিল এবং এখনও আছে যারা বরাবরই ধর্মীয় পরিবেশের গান-বাজনার অনূকুলে এবং আমি নিজেই বহু আলেম-হাজীকে অলিদের ওরশের গানে বা ওরশ ছাড়াও অন্যান্য গানের মাহফিলে যোগদান করতে দেখেছি। এখনো বহু সংখ্যক সুন্নি আলেম, হাফেজ, হাজীগণ গানের মাহফিলে হাজির হচ্ছেন এবং এ বিষয়ের উপর তারা অনেক কিতাবাদিও রচনা করেছেন এবং এখনো করছেন। তারাও সে গানে আল্লাহ, রাছুল, পীর- মুর্শিদগণের তথা আল্লাহর অলীগণের প্রেমসূধা পান করেছেন, গান-বাজনা জায়েজ বলে ফতোয়া দিয়েছেন, এখনো দিচ্ছেন। আর ওহাবী কাঠমোল্লারা ধর্মীয় গান বাজনাকে হারাম বলে ফতোয়াবাজি করছে, লজ্জাহীনতা আর কাকে বলে! ইমাম গাযযালী (রঃ)-এর ভাষায় ওরা শুকরের চেয়ে নিকৃষ্ট (ইহইয়াউ উলুমুদ্দীন -১১৯৩)। প্রমাণস্বরূপ পড়ে দেখতে পারেন “আসরারে ছামা” যুগান্তর সৃষ্টিকারী বইটি। কওমী-খারেজি মাদ্রাসার মৌলবীরা তখন এতোটা উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি। কারণ, তখনো ওহাবীদের মাদ্রাসা এতো ব্যাপক বিস্তার লাভ করেনি। এখন যেমন, ঘরের কোনায়, বাথরুমের ফাঁকা জায়গায়, হাটে বাজারের কোনায়, জঙ্গলের ধারে, রাস্তার পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো কওমী মাদ্রাসা তৈরী হচ্ছে তা তখনো এতো ব্যাপক ছিল না বিধায় মানুষের মনে শান্তি বিরাজ করতো।

ধীরে ধীরে তাদের মাদ্রাসার ব্যাবসা (ইহুদী-খ্রিষ্টানদের দালাল কুখ্যাত ওহাবী সৌদি সরকারের মদদপুষ্টে, তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে, ওহাবীদের বিকৃত মতবাদ প্রচার-প্রসার করার জন্য এবং মাদ্রাসার ব্যাবসায় নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হওয়া মূল কারণ) যতোই বিস্তার লাভ করছে ততোই দ্বীনে মুহাম্মদী/দ্বীন ইসলামের এবং অলী-আউলিয়াদের বিরোধীতা বেড়ে চলছে, অলীদের ওরশ মাহফিলের, গানের, তাজিম সেজদার, মিলাদের, তবারক সহ স্বয়ং রাছুলপাক (সাঃ)-কে নিয়েও নানা রকম বিতর্ক চালাচ্ছে! ফতোয়াবাজি, জোর-জুলুম, মানুষ হত্যা ইত্যাদি ব্যাপক বিস্তার লাভ করছে। সমাজের নির্মল আনন্দময় পরিবেশকে কওমী ওহাবীদের ধর্মীয় (?) উন্মাদনায় তথা বিষময় করে তুলছে। ধর্মান্ধগণ স্বার্থোদ্ধারের জন্য এবং জান্নাত আর হুর-পরীর নেশায় মাতাল হয়ে প্রেত-নৃত্য করে চলছে। আমি কোনো রাজনীতি করি না বা কোনো রাজনীতির সাথে আমার সম্পৃক্ততাও নেই। তবে হ্যাঁ, নবী-রাছুল, আল্লাহর অলী-আউলিয়াদের মতাদর্শে আমি পূর্ণ উজ্জীবিত আছি, থাকবো। কারণ, এরাই একমাত্র “আল ইসলামু দ্বীনুল ফেৎরাত বা লা ইকরাহা ফিদ্দ্বীন বা ওয়াল ফেৎনাতু আশাদ্দু মিনাল কাতলে”বা সিবগাতাল্লাহ-য় পরিপূর্ণ সিক্ত আছে- এরাই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে।

যে সরকারের দ্বারা মুক্ত মনের অধিকারী অলী-আউলিয়াদের তরিকা (দ্বীনে মুহাম্মদী/দ্বীন ইসলামের) বা অন্যান্য ধর্মের লোকদের এবং তাদের ধর্ম কর্ম এবং নিরাপত্তাবোধ করবে আমি/আমরা সে সরকারকেই সমর্থন করি এবং করবো। তাই বলছি, এ ধর্ম ব্যবসায়ী গোঁড়া জঙ্গি মৌলবাদ এবং তাদের অনুসারী গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে প্রগতিশীল আওয়ামী লীগ সরকার যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। বিশেষ করে তাদের গলায় মাষ্টার্স ডিগ্রির টাইটেল ঝুলিয়ে কিছুটা হলেও শান্ত করেছেন, যেন শান্তিতে দেশ পরিচালনা করা যায়। ইহাই রাজনৈতিক কৌশল। তারপরও বিশ্বাস করা যায় না, ওরা খুবই গোঁড়া, উগ্র এবং উচ্ছৃঙ্খল। স্বার্থোদ্ধার না হলে বা সুযোগ পেলেই ওরা বানর নৃত্য শুরু করবেই। কারণ, এ কওমীরা কতোটুকু ভয়ংকর নরপশু তা ২০০৪ সালের ২১ শে আগষ্টের বোমা হামলা হতে রক্ষা পেয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন, আরো টের পেয়েছেন আমাদের আড়াইহাজার উপজেলার এমপি আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম বাবু। সে বোমাবাজদের প্রধান ছিল কওমী মাদ্রসার মুফতি হান্নান। ১৯৮১ সালের পর হতে শেখ হাসিনাকে অন্ততঃ ২০ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০০০ সালের ২০ জুলাই কোটালীপাড়ায় সমাবেশস্থলে ৭৬ কেজি ও হেলিপ্যাডের নিকট ৪০ কেজি ওজনের শক্তিশালী দুটি বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে-মুফতি হান্নান নিজেই তা আদালতে স্বীকার করেছেন।

এ জঙ্গিবাদের কর্মে মুফতি হান্নানের সহযোগী ছিল মাওলানা আমিরুল ইসলাম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম এবং তাদের মতাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে এ জঘন্য কর্মে সহযোগী হয়েছে আরো ১২ জন। এ ১৪ জন ধর্ম সন্ত্রাসী জঙ্গিদেরকে গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আদালতে (যুগান্তর-২৪-৩-২০২১ই)। আশ্চর্য় যে যখন তাদেরকে ফাঁসি দেয়া হয়, কোনো হত্যাকান্ডে বা ধর্ষণের অভিযুক্ত হয়ে বা বলাৎকারের কারণে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার কারণে বা জঙ্গিবাদের কারণে হাত বেধে কোর্টে বা থানায় নেয়া হয় তখনো তাদের মাথায় স্বগৌরবে টুপি পাগড়ী দেখা যায়। তাতে টুপি-পাগড়ীর মর্যাদাটি বাড়লো নাকি কমলো তা বোধসম্পন্ন লোকের জন্য বুঝা কোনো দূর্বোধ্য বিষয় নয়! তাদের জঙ্গি মতাদর্শের অনুসারী বা সাধারণ কিছু মানুষ যারা জুব্বা-টুপি-পাগড়ি দেখে বড় বড় মৌলবী বুঝে তারাও তাদের সমর্থন দিয়ে বলতে থাকে, ওরা ‘আলেমে দ্বীন’ তাদেরকে গ্রেফতার করা বা ফাঁসি দেয়া ঠিক হয়নি। এ মতাদর্শে উজ্জিবীত হয়েই রাস্তায় নেমে বানর নৃত্য শুরু করে দেয়। ওরা কতো ভয়ংকর ধর্ম চোর, ধর্ম ব্যাবসায়ী সে সম্পর্কে বিন্দু মাত্রও এ সমস্ত নির্বোধ গুলোর ধারণা নেই। বাংলার চিরশত্রু রাজাকার ‘জামায়াতে মওদুদী’ আর অন্যান্য জঙ্গি মৌলবাদিদের আকিদা একই, শুধু দল ভিন্ন। সব মৌলবাদিদের ঈমান-আকিদা জামায়াতে মওদুদীর সাথে অভিন্ন সর্ম্পক আছে।

আজকে কওমীরা যাকে ‘কওমী জননী’ বলছে, সে কওমীদের নানা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীনতাকে পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিলেও কওমীদের গুরু ঠাকুর (বলা যায় তাদের ছানি নবী), যাদের মতাদর্শের দোহাই দিয়ে অনুসরণ-অনুকরণ করে আসছে সেই সৌদি সরকার কিন্তু বাংলার স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়নি শেখ মুজিবুর রহমানকে শহীদ না করা পর্যন্ত। যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে কুখ্যাত সৌদি ওহাবী সরকার সন্তুষ্ট হয়ে তার পরের দিনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছিল। এ সমস্ত অন্ধ-গোঁড়া, উগ্র-উচ্ছৃঙ্খল মৌলবাদিগণ রাছুলেপাক (সাঃ)-এর পর হতেই বিভিন্ন নামে এরা আত্মপ্রকাশ করছে। যুগে যুগে তাদের ধর্মীয় উন্মাদনার কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ওরা হত্যা করেছে/করছে। বর্তমানে ওরা কওমী ওহাবী বলেই পরিচিত। তাদের দ্বিতীয় ঘাঁটিটি হলো দেওবন্দ মাদ্রাসা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে তাদের মধ্যে অন্ততঃ ৪০/৪৫টি শাখা রয়েছে। তার জন্য পড়ে দেখতে পারেন “পরহেজগারীর আড়ালে ওরা কারা !!!” বইটি।

কওমীদের নেতা মৌলবী শফিতো বলেই ফেললেন, “ঈদে মিলাদুন্নবীর মতো জঘন্য বিদআতে লিপ্ত হবেন না (দৈনিক নতুন বাংলাদেশ ও অন্যান্য পত্রিকা)।” মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্ম দিনের আনন্দ উৎসব পালন করলে যদি জঘন্য বিদআত হয়, তা হতে বিরত থাকলে হেফাজতি কওমীরা আনন্দ পায়, ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করলে তাদের মনোকষ্ট হয়, তবে আবু জাহেল আর আবু লাহাবের জন্মদিন পালন করলে মনে হয় নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে আনন্দ সৃষ্টি হবে ! মূলতঃ ওদের আকিদা তা-ই। ওরাই মুনাফিক মুয়াবিয়া, ইয়াজিদ, জুলখাইশ, আবু সুফিয়ান, আবদুল্লাহ ইবনে উবাইদের প্রেমিক। তাদের ভাষায় মিলাদ কিয়াম বেদআত, ওরশ বেদআত, গান বাজনা নাজায়েজ, তাজিম সেজদা শেরেক, বায়াত হওয়া লাগবে না, বাবরি চুল না জায়েজ ইত্যাদি ভুতের মন্ত্র আওড়িয়ে চলছে।

আর ধর্ম শিক্ষার নামে স্লোগান দিয়ে মাদ্রাসায় পর্দা উন্মোচনের নিত্য লীলা করে নারী ধর্ষণ জায়েজ, শিকল বন্দি করে পালাক্রমে বাচ্চাদের বলাৎকার করা জায়েজ, চুক্তি করে ইমামতি করা জায়েজ, চুক্তি করে ওয়াজ করা জায়েজ, ধর্ষণের পর হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে মসজিদে গিয়ে ফজর নামাজ পড়ানো জায়েজ, ইমামতির চাকরী নিয়ে বিয়ের কথা গোপন করে আরো ৮/১০টি বিয়ে করা জায়েজ, নারীদের ধর্ষণ করা জায়েজ, মসজিদের মৌলবীর সাথে বিয়ে দিলে বেহেশতে নিয়ে যাবে এ কথা বলে ধর্ষণ করা জায়েজ, নবীর ঘরের (?) দোহাই দিয়ে চাঁদাবাজি-ভিক্ষা-খয়রাতি করা জায়েজ, মসজিদ-মাদ্রাসার নামে চাঁদাবাজি- ভিক্ষা-খয়রাতি করে টাকা ভাগ করে নেওয়া জায়েজ, ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করিয়ে লজ্জা-শরম ভাঙ্গানো জায়েজ, ওয়াজের নামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাঁশ সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে টাকা কামানোর ফন্দিফিকির করা জায়েজ, ইয়াতিমখানার নামে সরকারী এবং জনগণের টাকা আত্মসাৎ করা জায়েজ, গাঁজা, ইয়াবা, নকল টাকার ব্যবসা করা জায়েজ, রমজান মাসে ধনী লোকদের দাওয়াত দিয়ে মাদ্রাসার নামে টাকা কামাই করার মতলবটি জায়েজ, বাড়ি বাড়ি/রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বা গাড়িতে ভূয়া রিসিপ নিয়ে মসজিদ-মাদ্রাসার নামে ভিক্ষা-খয়রাতি করে টাকা কামাই করা জায়েজ, -এ ধরনের হাজারো কথা বলা যায় ; তাতেই প্রমাণ ওরা নিজেরাই বহু অন্যায়-অবৈধ কর্মে দিবানিশি কায়েম আছে। এ সমস্ত ক্রিয়া-কর্মগুলো বলুন কোরান-হাদিসের কোথায় পেয়েছেন ? জবাবে হয়তো লেংড়া-লুলা মার্কা কতোগুলো খোঁড়া যুক্তি, নয়তো আপনাদের সমমনা কোনো মোল্লাদের দোহাই দিয়ে ভূতের মন্ত্র আওড়াবেন। পীর-ফকির বা তাদের অনুসারী দের নিকট কথায় কথায় অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দলিল খুঁজে বেড়ান, নিজেদের গায়ে যে হাজার ছিদ্র তা কি চোখে পড়ে না ? পড়লেও দেখবেন না। কারণ, তাহলে ধর্ম ব্যাবসাটি আপসে করে বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে যে তাই !

এ সমস্ত কথাগুলো তুলে ধরলেই অজ্ঞ-মূর্খদের ভাষায় ধর্ম বিরোধী কথা হয়ে যায়, আর তাতে বাহাত্তুর কাতারের লোকজনের পক্ষ হতে হয়তো আদিম চরিত্রের বহিঃপ্রকাশস্বরূপ গোঁয়ার গোবিন্দের মতো প্রেত-নৃত্য করে তার প্রতিবাদ আসবে। ওরা ধর্মের কিছুই বুঝেনি। বুঝে নি ‘রূহে ইনছানির অধিকারীত্বে আসাটাই মানব ধর্ম, দ্বীন ইসলাম।’ আপনার বিবেককে জিজ্ঞেস করুন (যদি বিবেক জাগ্রত থাকে) কথাগুলো কতোটুকু সত্য।

আপন খবর