আপন ফাউন্ডেশন

প্রখ্যাত ওলী হযরত হাবীব আযমী রহ. এর পবিত্র জীবন

Date:

প্রথম জীবনে হযরত হাবীব আযমী (র) ছিলেন বসরার এক বিত্তশালী সুদ ব্যবসায়ী। সুদের বিরাট কারবার। শহরে প্রচুর তাঁর খাতক। তিনি তাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সুদ আদায় করেন । খুব কড়া লোক। কঠোর হৃদয় ।

একদিন সুদ আদায়ে তিনি গেলেন এক খাতকের বাড়ি। বাড়ির মালিক তখন অনুপস্থিত। তার স্ত্রী বলল, সে তো নেই। আর আপনাকে দেবার মতো টাকাও নেই। অতএব সুদের মহাজন কিন্তু শুনবেন না। কিছু আদায় না করে খালি হাতে তিনি কিছুতেই ফিরবেন না । বললেন, টাকা না থাক, আর কিছু কি নেই? যা আছে, তাই দাও। স্ত্রীলোকটি বলল একটি ছাগলের মাথা আছে, যদি ঋণের সুদ হিসেবে নিতে চান, তবে তাই দিতে পারি । মহাজন তাতেই খুশি। বললেন, তাই দাও ।

অতএব ছাগলের মাথা নিয়েই তিনি বাড়ি ফিরলেন। গিন্নিকে বললেন রান্না করতে । গিন্নি জানালেন, বাড়িতে আজ রুটিও নেই জ্বালানীও নেই। অতএব মহাজন ছুটলেন অন্য এক খাতকের বাড়িতে। রুটি আর জ্বালানী এনে স্ত্রীকে দিলেন। রান্না হল। উত্তম রান্না। আর তা পরিবেশিত হল।

মহাজন খেতে বসে গেলেন। আর তখন- তখনই এক ভিখারি এসে দরজার দাঁড়ায় । তার প্রার্থনা-কিছু খাবার। মহাজন সরাসরি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, এখানে কিছু হবে না। এখন ঘরে যা আছে, তা দিলেও তোমার পেট ভরবে না। অথচ আমার অসুবিধা হবে। ভিখারি আর কী করে। নিঃশব্দে চলে যায়। এধারে মহাজনের বউ পেয়ালায় মাংস ঢেলে অবাক । মাংস কোথায়? শুধু রক্ত। টকটকে লাল তাজা রক্ত। তিনি ভয়ে ভয়ে স্বামীকে বলেন, দেখুন কী ব্যাপার! মাংস ঝোল সব রক্তে পরিণত হল কেন?

দেখে-শুনে মহাজনও হতভম্ব। অবাক কাণ্ড! কোথা থেকে কী হল, ভাবতে ভাবতে তাঁর মনে ভাবান্তর দেখা দিল। কী কারণে এক পেয়ালা মাংস রক্তে পরিণত হল, বুঝতে তাঁর অসুবিধা হল না। ভয়ে বুক কেঁপে উঠল তাঁর। সুদের বদলে মানুষের রক্ত শুষে খেয়েছেন তিনি। তাই আজ ঠোঁটের কাছে রক্তের পেয়ালা। স্ত্রীকে বললেন, এ আমার এতদিনের কুকর্মের ফল। এ মুহূর্তে আমি প্রতিজ্ঞা করছি জীবনে আর সুদের কারবার করব না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমার ওপরে গজব পাঠাবেন। এটি তারই পূর্বাভাস।

পরের দিন, সুদের বদলে মূল টাকা আদায়ের উদ্দেশ্যে মহাজন বেরিয়ে পড়লেন। কিছুদূর গিয়ে দেখলেন, কয়েকটি ছেলে খেলা করছে। তাঁকে দেখামাত্র ছেলেরা বলে উঠল, ঐ যে সুদখোর আসছে। চল, তাড়াতাড়ি কেটে পড়। না হলে এর গায়ের বাতাস গায়ে লাগলে আমরাও ঘৃণিত মানুষ হয়ে যাব। বলতে বলতে তারা সত্যিই দৌড়ে পালাল ।

কথাগুলো কানে গিয়েছিল মহাজনের। লজ্জায়-দুঃখে তিনিও যেন মাটিতে মিশে যেতে চাইলেন। মনে এল প্রচুর অনুশোচনা ও ধিক্কার। পৃথিবী অর্থহীন হয়ে গেল। আর খাতকদের সঙ্গে দেখা করা নয়। মত যখন পরিবর্তিত হয়েছে, তখন পথেরও পরিবর্তন প্রয়োজন ৷ পথযাত্রা তিনি ঘুরিয়ে দিলেন হযরত হাসান বসরী (র)-এর দরবারের দিকে। মহাসাধক হাসান বসরী (র) তাঁকে তওবা পড়িয়ে দ্বীন-দুনিয়া সম্পর্কে কিছু অমূল্য উপদেশ দিলেন ।

হাসান বসরী (র)-এর দরবার থেকে বাড়ি ফিরছেন। পথে এক খাতকের সঙ্গে দেখা। আর রক্তশোষক মহাজনকে দেখামাত্র সে দৌড়াতে লাগল আর কী! কিন্তু মহাজন বললেন, শোন, তোমার আর পালাবার দরকার নেই; বরং এখান থেকে আমারই পালিয়ে যাওয়া উচিত। এরপর আরো একদিন পথে বেরিয়েছেন তিনি । দেখলেন, আজও বেশ কিছু ছেলে রাস্তার ওপর খেলা করছে। মহাজনকে দেখে তারা খেলা বন্ধ করে। বলতে থাকে, এখন খেলা উচিত নয়। ঐ দেখ, তওবাকারী আসছেন। তাঁর গায়ে যদি ধুলোবালি লাগে তাহলে আমাদের পাপ হবে। তাছাড়া তিনি যদি এভাবে আমাদের খেলতে দেখেন, তাহলে অখুশিও হবেন ।

অর্থাৎ, হযরত হাসান বসরী (র)-এর নিকট তওবা করে তিনি যে আল্লাহর উপাসনা শুরু করেছেন, সে খবর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে।

ছেলেদের মুখে এসব কথা শুনে মহাজনের বুকে যেন আবেগের ঢেউ ওঠে। কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হয়ে তিনি আল্লাহর উদ্দেশ্যে বলেন, হে মহিমাময়! আপনার মহিমার অন্ত নেই। মাত্র কয়েকটি দিন হল, আমি আপনার পথ অবলম্বন করেছি। অথচ এর মধ্যে আপনি ছেলেগুলোর মনে আমার প্রতি একটি সশ্রদ্ধ ভাব এনে দিয়েছেন । আপনি পারেন না, এমন কিছু নেই ।

পরদিনই তিনি ঘোষণা করে দিলেন, যেসব লোক মহাজনের কাছে সোনা-রুপোর গয়না বন্ধক দিয়ে সুদে টাকা ধার নিয়েছে। তারা যেন অবিলম্বে ঐ সব বন্ধকী মাল ফেরত নিয়ে নেয় । আর তার জন্য ঋণের টাকা দিতে হবে না । তিনি সবকিছু মওকুফ করে দিয়েছেন।

ঘোষণা শুনে শহরশুদ্ধ লোক খুশি। সবাই দোয়া জানান তাঁকে । আর ফিরিয়ে নিয়ে গেল নিজ নিজ সোনা ও রূপার বন্ধকী মাল। তাছাড়া, মহাজনের যা কিছু নিজস্ব ছিল, তাও তিনি বিলিয়ে দিলেন গরিবদের মাঝে। এমনকি তাঁর নিজের একটিমাত্র জামা ও আর তাঁর স্ত্রীর একখানি শীতবস্ত্র—তাও দিয়ে দিলেন এক মিসকিনকে। যিনি ছিলেন এক রক্তশোষক জোঁক, তিনি একদা হয়ে গেলেন সর্বস্বত্যাগী দীন ভিখারি। বিষয়াসক্তির প্রাবল্য ছিল যার শিরায় শিরায়, আল্লাহর অনুপম ইচ্ছায় স্বার্থশূণ্য মাসুম দরবেশ হয়ে গেলেন। কে এই কুসীদজীবী মহাজন, যিনি অপাপবিদ্ধ মহাতাপসে রূপান্তরিত হলেন?

তিনি হযরত হাবীব আজমী (র)। ইরানের আজম এলাকায় ছিলেন বলে তাঁর নামটি আজমী খচিত হয়। তাঁর কঠোর জীবন-সাধনা বিশ্বের বিস্ময়। সত্যবাদিতা, সততা ও নিষ্ঠার জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। লক্ষণীয় হল, তিনি হযরত হাসান বসরী (র)-এর সমসাময়িক সুখ্যাত সাধক ৷

হযরত হাবীব আযমী (র) ইবাদতে নিমগ্ন হলেন ।

নিঃস্ব অবস্থায় সংসারচক্র থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে হযরত হাবীব আজমী (র) আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর জন্য ফোরাত নদীকূলে একটি কুটির নির্মাণ করলেন। দিনের বেলায় তিনি পাঠগ্রহণ করতেন হযরত হাসান বসরী (র)-এর কাছে। আর দিন ফুরালে কুটিরে গিয়ে মহান প্রভুর ইবাদতে মগ্ন হতেন। তাঁর স্ত্রীও স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন । দিন যেতে লাগল ।

উপবাসে, অর্ধোপবাসে তাঁর স্ত্রী কিন্তু অচিরেই কাতর হয়ে পড়েন। আর স্বামীর কাছে কিছু খাবার চান। হাবীব আজমী (র) বলেন, ঠিক আছে, তোমার কোন চিন্তা নেই। আমি এখুনি মজুর খেটে কিছু রোজগার করে আনছি ।

বললেন বটে, কিন্তু মজুর না খেটে তিনি হযরত হাসান বসরী (র)-এর বাড়ি হয়ে সোজা চলে গেলেন নদী-তীরবর্তী ইবাদতখানায়। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলে তাঁর স্ত্রী আবার খাবারের খোঁজ নিলেন। হযরত হাবীব আজমী (র) বললেন, আমি যে মনিবের মজদুরি শুরু করেছি, তিনি এক বিরাট মহাজন। সবেমাত্র কাজ শুরু করছি। এক্ষুণি মজুরি চাইতে লজ্জা লাগছে। কম করেও দশটা দিন যাক। তখন কিছু চাইব বলে মনে মনে ভেবে রেখেছি। তুমি খুব কষ্ট সহ্য করছ তা বুঝছি। তবে আরো একটু ধৈর্য ধর। নিশ্চয়ই এর বিনিময়ে কিছু পাব। এত কষ্ট বৃথা যেতে পারে না ।

স্ত্রী আর কিছু না বলে চুপচাপ রইলেন।

সময় নিঃশব্দে পার হয়ে গেল। হযরত হাবীব আজমী (র) নিবিড় সাধনায় মগ্ন। দেখতে দেখতে ন’ দিন কেটে গেল। দশম দিনে স্ত্রীর কাছে বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল তাঁর। তিনি এবার ভাবছেন, আজ গিয়ে তাঁকে কী বললেন? কী নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। দারুণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি ।

এদিকে হযরত হাবীব আযমী (র)-এর গৃহিনী বাড়িতে একা । তখন সন্ধ্যা উতরে গেছে। প্রতি মুহূর্তে স্বামীর প্রত্যাগমনের প্রত্যাশায় রয়েছেন তিনি। আজ দশদিন। অবশ্যই কিছু আহার্য নিয়ে সহাস্যে তিনি বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়াবেন। ঐ বুঝি তাঁর পদধ্বনি। হ্যাঁ, তাই তো, পায়ের আওয়াজই বটে। তবে তাঁর নয়, দুয়ারে চার তরুণের মিলিত পায়ের শব্দ শোনা গেল । অবাক হয়ে তাপসপত্নী দেখলেন, তরুণেরা সঙ্গে এনেছে এক বস্তা আটা, বিরাট এক পাত্রভর্তি মাংস, এক ভাড় মধু, এক ডিবা ঘি, আর তিনশ দিরহাম ভর্তি একটি থলে । তাঁরা বললেন, আপনার স্বামীর মনিব তাঁর কাজের মজুরি পাঠিয়ে দিলেন। তিনি এলে বলবেন, তাঁর কাজে যত বেশি উন্নতি হবে, তাঁর মজুরিও তত বেড়ে যাবে।

মালপত্র নামিয়ে দিয়ে তাঁরা চলে গেলেন। আর কিছুক্ষণ পরে, অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে লঘুপায়ে বাড়িতে এলেন হযরত হাবীব আযমী (র)। মুখে বিষন্ন ছায়া। পত্নীকে মৌখিক সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া তাঁর কোন গত্যন্তর নেই। অনশনক্লিষ্ট পত্নীর চোখের দিকে তিনি তাকাবেন কী করে? আর তাঁর প্রশ্নের জবাবে কী-ই বা উত্তর দেবেন? কিন্তু, ওকি! পত্নীর উপবাসী-মুখের দিকে চেয়ে তাঁর মনে হল, মুখখানি প্রসন্ন প্রফুল্ল। আর ঘরের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে মধু ও খাঁটি ঘিয়ের মধুর গন্ধ । অবাক হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার বল তো?

স্ত্রী বললেন, আপনার মনিব খুব ভাল লোক। সবকিছু পাঠিয়ে দিয়েছেন। পুরো ঘটনা শুনে হযরত হাবীব আযমী (র) আল্লাহর উদ্দেশ্যে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। তিনি অন্তর্যামী সর্বদর্শী। নিজের দায়িত্ব পালনে অনলস। তাই প্রিয় বন্ধুর প্রতি কর্তব্য পালনে কোন ত্রুটি হয়নি। তরুণের ছদ্মবেশে ফেরেশতা পাঠিয়ে জান্নাতী সওগাত দিয়ে গেছেন । স্ত্রীকে বললেন, দেখলে গো, একটু কষ্ট স্বীকার করে আল্লাহর ওপর নির্ভর করায় তিনি কী উপঢৌকন দিয়ে গেলেন ।

তাঁর সাধনা আরো গভীরতর পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় । তিনি মানুষের জন্য যা দোয়া করেন, তা ফলপ্রসূ হয়। একদিন এক মহিলা তাঁর দরবারে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে। বহুদিন হল আমার একমাত্র ছেলে হারিয়ে গেছে। তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমার চোখ অন্ধকার । বেঁচে থাকা অর্থহীন । আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। যেন তিনি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেন।

তিনি বললেন, তোমার কাছে কি কিছু আছে ?

সে দু’টি রূপোর টাকা বের করে দিল। হযরত হাবীব আযমী (র) টাকা দু’টি এক ভিখারিকে দান করে দিলেন। তারপর পুত্রহারা জননীকে বললেন, মা গো! বাড়ি যাও। গিয়ে দেখবে, তোমার ছেলে বাড়ি ফিরেছে। আর একথা শুনে সে ছুটে গেল বাড়ির পথে । দূর যেতে হল না । জননীর কণ্ঠে উচ্ছ্বসিত হল সানন্দ আবেগ- দয়াময়! আপনার দয়ায় আমি আমার হারানো নিধি ফিরে পেয়েছি। এদিকে মাকে পথে দেখতে পেয়ে ছেলেও ছুটে এল তার কাছে। বলল, আমি পথ হারিয়ে কেরমান শহরে গিয়ে পড়েছিলাম। আমাকে দেশে পৌছে দেবার মত কোন লোক আমি পাইনি। অগত্যা একজন শিক্ষকের কাছে আমি লেখাপড়া শুরু করি। উনি আমাকে বাজারে মাংস কিনতে পাঠান। মাংস কিনে বাজার থেকে ফিরছি, হঠাৎ এক প্রচণ্ড ঘূর্ণিবায়ু আমাকে শূন্যে উঠিয়ে নিল। তার পূর্ব-মুহূর্তে আমার কানে আসে, কে যেন বাতাসকে বললে, হে বাতাস, তুমি ছেলেটাকে তার দেশে পৌঁছে দাও ।

মনে পড়ে হযরত সুলায়মান (আ) বাতাসের ওপর ভর করে একমাসের পথ একদিনে পাড়ি দিতে পারতেন। রাণী বিলকিসের সিংহাসন চোখের পলকে হযরত সুলায়মান (আ)-এর রাজধানীতে অনীত হয় । যখন যা ইচ্ছা, আল্লাহ্ তখনই তা করতে পারেন। তাঁর বায়ুযানের চেয়ে দ্রুতগামী যান কবে কোন্ মানুষ তৈরি করতে পেরেছে? ঐশী ক্ষমতার কি কোন তুলনা আছে?

বসরা শহরে একবার ভীষণ দুর্ভিক্ষ। খেতে না পেয়ে সাধারণ মানুষ মৃত্যুর কবলে নিমজ্জিত। হাবীব আজমী (র) বড় বড় বণিকের কাছ থেকে বাকিতে খাদ্যশস্য কিনে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। পরে মহাজনরা টাকা আদায়ে এলে একটি থলে থেকে টাকা বের করে তিনি যাবতীয় পাওনা শোধ করে দিতেন। বলা হয়, ঐ টাকার থলেটি তাঁর বালিশের তলায় থাকত। আর যখনই টাকা বের করতেন, তখনই থলেটি আপনা হতে আবার পূর্ণ হয়ে যেত ।

আরো অশ্চর্যের কথা, হজ্জ মওসুমে জিলহজের ৮ তারিখ বসরার লোক তাঁকে বসরায় দেখতে পেতেন। পরদিন, ৯ জিলহজ তাঁকে দেখা যেত মক্কা শরীফে বসরা থেকে আগত হজযাত্রীদের সঙ্গে তিনি আরাফাতের ময়দানে যাচ্ছেন। অথচ বসরা থেকে মক্কা বেশ কয়েকদিনের পথ।

দু মহা-তাপসের মিলন : বসরার এক চৌরাস্তার পাশে ছিল হযরত হাবীব আজমী (র) এর বাড়ি। তিনি প্রায়ই একটি চামড়ার পোশাক পরতেন। একদিন জামাটি খুলে চৌরাস্তার ওপর রেখে তিনি কোন কাজে গেলেন । কিছুক্ষণ পরে ঐ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন হযরত হাসান বসরী (র)। জামাটি দেখে তাঁর মনে হল আত্মভোলা হাবীব হয়তো ভুলে জামাটি এখানে ফেলে গিয়েছে। এভাবে এটি এখানে পড়ে থাকলে কেউ কুড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে ভেবে তিনি ওখানে পায়চারী করতে লাগলেন। ইতোমধ্যে হযরত হাবীব আজমী (র) ফিরে এলেন । আর পায়চারীরত তাপসকে দেখতে পেলেন। তিনি হযরত হাসান বসরী (র)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার এখানে এভাবে পায়চারী করার কারণ কী হুজুর?
হাসান বসরী (র) বললেন, তুমি কার ওপর ভরসা করে জামাটি এখানে ফেলে রেখে গিয়েছ মনভোলা?

হাবীব আজমী (র) উত্তর দিলেন, যিনি আপনাকে এর পাহারায় মোতায়েন করেছেন, তাঁরই ওপর নির্ভর করেছিলাম। তাঁর উত্তর শুনে হযরত হাসান বসরী (র) তাঁকে অভিনন্দন জানালেন, বললেন হাবীব! তুমি ধন্য ।

একদিন হযরত হাসান বসরী (র) হঠাৎ এসে পড়লেন হযরত হাবীব আজমী (র)-এর বাসভবনে। তাঁর ভাণ্ডারে তখন যবের রুটি আর সামান্য লবণ ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। তিনি তা-ই এনে হযরত হাসান বসরী (র)-এর সামনে উপস্থিত করলেন। আর মহামান্য অতিথিও দ্বিরুক্তি না করে দিব্যি বসে গেলেন আহারে। আর তখন- ঠিক তখনই দরজায় হাঁক দিল এক ভিখারি। সে-ও কিছু খাবার চায়। হাবীব আজমী (র) করলেন কী, হাসান বসরী (র)-এর খাবারপাত্র থেকে পুরো রুটিখানা আর লবণটুকু তুলে নিয়ে ভিক্ষুককে দিয়ে দিলেন।

এবার হযরত হাসান বসরী (র) বললেন, তোমাকে সুযোগ্য লোক বলে আমি মনে করতাম এবং এখনো তাই করি। কিন্তু তাঁর সাথে জ্ঞানেরও সংযোগ ঘটলে ভাল হত। মেহমানের সামনে থেকে এভাবে সম্পূর্ণ খাবার উঠিয়ে নেয়া জ্ঞানীর কাজ নয় ।

হযরত হাবীব আযমী (র) নিরুত্তর রইলেন। পরে তাঁরই এক পরিচারক খাঞ্চাভর্তি খাবার এনে হাজির। নানা রকম সুস্বাদু, উত্তম খাবার। খাঞ্চায় পাঁচশ মুদ্রাও ছিল। হযরত হাবীব আযমী (র) মুদ্রাগুলো গরিব লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। অতঃপর মহান অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে খেতে বসলেন । খাওয়া শেষ হল পরম পরিতৃপ্তি সহকারে। শেষে হযরত হাসান বসরী (র)-কে উদ্দেশ্য করে হযরত হাবীব আযমী (র) বললেন, হযরত! আপনি খুব বড় সাধক সন্দেহ নেই। আপনি বিদ্যা ও জ্ঞানের সাগরও বটে। তবে এর সাথে কিছুটা বেশি ইয়াকীন থাকলে আরো ভাল হত ।

হযরত হাবীব আজমী (র) একদিন মাগরিবের নামাযের ইমামতি করছেন। এ সময় হযরত হাসান বসরী (র) এসে জামাতে শামিল হলেন। নামায পড়ার সময় হাবীব আজমী ঠিকভাবে সূরা ফাতিহার আলহামদু শব্দের উচ্চারণ করতে পারলেন না। তাঁর অশুদ্ধ উচ্চারণ শুনে হযরত হাসান বসরী (র) মনে করলেন, এ ইমামের পেছনে নামায পড়লে তো আদায় হবে না । তিনি করলেন কী জামাত ছেড়ে একা-একা আলাদা নামায পড়লেন ।

আর ঐ রাতেই হযরত হাসান বসরী (র) এক স্বপ্ন দেখলেন। তিনি যেন আল্লাহর কাছে জানতে চাচ্ছেন, হে আমার প্রতিপালক, আপনার সন্তুষ্টি লাভের উপায় কি? মহিমাময় আল্লাহ্ তাঁকে জানালেন, তুমি আমার সন্তুষ্টি লাভ করেছ ঠিকই, কিন্তু তার মর্যাদা রক্ষা করনি। কেমন করে প্রভু? তিনি ফের জিজ্ঞেস করলেন। আল্লাহ্ বললেন, তুমি আমার প্রিয়জন হাবীবের কিরাত পাঠের অশুদ্ধতাই দেখলে, অথচ তাঁর অন্তরের বিশুদ্ধতার দিকে নজর দিলে না। জেনে রেখো, বহিরঙ্গের বিশুদ্ধতার চেয়ে অন্তরঙ্গের বিশুদ্ধতার অনেক বেশি মূল্য। আজ তুমি যদি হাবীব আজমীর পেছনে নামায পড়তে, তাহলে সে নামায তোমার জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট নামায হত ।

হযরত হাবীব আজমী (র) কিন্তু জীবনে সর্বোৎকৃষ্ট কাজই করেছেন। একবার হযরত হাসান বসরী (র) অত্যাচারী শাসক হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের সৈন্যদের ভয়ে হযরত হাবীব আযমী (র)-এর উপাসনালয়ে ঢুকে পড়েন। আর তাঁর পেছনেই সৈন্যদল এসে হাজির। তাঁরা হাবীব আযমী (র)-কে জিজ্ঞেস করল, হাসান গেল কোথায়? তিনি উত্তর দিলেন, মসজিদের মধ্যে আছেন। সেনারা তন্ন তন্ন করে মসজিদ খুঁজল । কিন্তু তাঁকে কোথাও পেল না। তারা আবার আজমী (র)-কে শুধালেন, ঠিক করে বলুন, তিনি কোথায় আছেন? হাবীব আজমী (র) বললেন, বলেছি তো, তিনি মসজিদেই আছেন।

তারা আবারও মসজিদ খুঁজে দেখল খুব ভাল করে । কিন্তু এবারও তাঁর পাত্তা পেল না । আর পাত্তা না পেয়ে তারা বিরক্ত হল। রেগেও গেল । তারপর রাগতস্বরে হযরত হাবীব আজমী (র)- কে বলল, হাজ্জাজ যে আপনাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন, তা তিনি ঠিকই করেন । আপনারা তার উপযুক্তই বটে। আপনারা মিথ্যাবাদী। মসজিদের কোথাও হাসান নেই, অথচ আপনি বলেছেন, তিনি এখানেই আছেন। হাবীব আযমী (র)-বললেন, আমি নিজের চোখে তাঁকে মসজিদে ঢুকতে দেখেছি। এখন আপনারা যদি তাঁকে দেখতে না পান তো, আমি কী করব?

তাঁর কথা তাদের বিশ্বাস হল না। তারা চলে গেল। আর হযরত হাসান বশরী (র) রেরিয়ে এসে হযরত হাবীব আযমী (র)-কে বললেন, ওরা যে বারবার আমার সামনে দিয়ে গেল, এমনকি আমার ওপর হাতও রাখল একবার, অথচ আমাকে শনাক্ত করতে পারল না । আমি দুঃখ প্রকাশ করছিলাম, আমি তোমার গুরু হওয়া সত্ত্বেও তুমি মসজিদে আমার প্রবেশ-সংবাদ ওদের জানিয়ে দিলে । তোমার কি এটা উচিত হয়েছে ?

হযরত হাবীব আযমী (র) বললেন, দেখুন সত্য তো বলতেই হবে। আর আমি সত্য বলেছি বলেই আপনি আজ বিপদের হাত থেকে বেঁচে গেছেন। না হলে, দু’জনেই বন্দী হতাম । হযরত হাসান বসরী (র) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন্ কালাম পাঠ করেছিলে হাবীব, যার বদৌলতে ওরা আমাকে দেখেও দেখতে পেল না ।

হাবীব আজমী (র) উত্তর দিলেন, আমি দু’বার পবিত্র আয়াতুল কুরসী, দশবার সূরা নাস ও দশবার ‘আমানার রাসূল’…….পাঠ করে আল্লাহর সমীপে বলেছিলাম, প্রভু আমার! আমি আমার গুরুকে আপনার হাতে সোপর্দ করলাম । আপনি তাঁকে রক্ষা করুন।

আল্লাহ্ তাঁর প্রিয়জনের কাতর প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। তিনি নির্বিঘ্ন রইলেন ।

হযরত হাবীব আজমী (র)-এর ঘটনাবলী : একবার দজলা নদীর পারে যাবার জন্য খেয়া নৌকার প্রতীক্ষায় আছেন হযরত হাসান বসরী (র)। এমন সময় কোথা থেকে সেখানে এসে পড়লেন হযরত হাবীব আজমী (র)। ওপারে যাবার জন্য তিনি নৌকার অপেক্ষায় আছেন। এ কথা জানতে পেরে হাবীব আজমী (র) বললেন, কেন হুজুর, আপনিই তো বলেছেন, মন পরিষ্কার রেখে পানির ওপর দিয়ে হেঁটে যাবে। অমি নিজে তা পরীক্ষা করেছি। এই দেখুন, বলে তিনি পায়ে হেঁটে পানির ওপর দিয়ে নদী পার হয়ে গেলেন। আর এ দৃশ্য দেখে হযরত হাসান বসরী (র) অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁর সস্তি ফিরে এলে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, আপনার কী হয়েছিল হুজুর? তিনি উত্তর দিলেন, আমার শিষ্য হাবীব আমার নির্দেশ অনুযায়ী আমল করে অনায়াসে নদী পার হয়ে গেল, অথচ আমি পারলাম না। তখন আমার মনে হঠাৎ বিচারদিবসের কথা উদয় হল, আমি কি পুলসিরাত পার হতে পারব? যদি না পারি, আমার কি হবে? এ কথা ভেবে আমি বেহুঁশ হয়ে যাই ।

পরে একদিন তিনি তাঁর সাগরিদেরকে বললেন, সেদিন তোমার যোগ্যতা দেখে আমি অবাক হয়েছি। বল, কোন্ আমল দ্বারা তুমি এ যোগ্যতা অর্জন করেছ?

হাবীব আজমী (র) বললেন, হুজুর, আপনারই শিক্ষা: (ক) মন থেকে হিংসা-বিদ্বেষ দূর কর। (খ) পার্থিব-জীবনের আসক্তি পরিহার কর। (গ) বিপদ-আপদকে সম্পদ বলে বিবেচনা কর। আর মনে-প্রাণে বিশ্বাস কর যে, সবই আল্লাহর ইচ্ছাতে হয় । এরপর আল্লাহর নাম স্মরণ করে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। তখন হযরত হাসান বসরী (র) আল্লাহকে সম্বোধন করে বললেন, প্রভু গো! অনেকেই আমার কাছে শিক্ষাগ্রহণ করে সফল হয়ে গেল! কিন্তু আমি নিজে যে অযোগ্য থেকে গেলাম ।

এসব ঘটনার বিবরণ শুনে মনে হতে পারে হযরত হাবীব আযমী (র) তাঁর গুরু হাসান বসরী (র)-এর চেয়ে ও উন্নত মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু বিষয়টি এভাবে নিলে ঠিক হবে না। আল্লাহর কাছে ইলমের মর্যাদা অনেক বেশি। রাসূলুল্লাহ (স) কে সম্বোধন করে রাব্বুল আলামীন বলেছিলেন, হে নবী, আপনি প্রার্থনা করুন, হে প্রভু! আপনি আমার ইলম বৃদ্ধি করুন ।

পণ্ডিতগণ বলেন, তরীকতের পথে কারামতের দরজা চৌদ্দ আর মারেফাতের আঠারো। কারামত সফল হয় উপাসনার মাধ্যমে। আর মারেফাতের সাফল্য নির্ভর করে ইলম-প্রজ্ঞা তথা বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, ধ্যান, গবেষণার ওপর ।

হযরত সুলায়মান (র) একাধারে আল্লাহর নবী আর মহাশক্তিরধর সম্রাট ছিলেন। জ্বিন- পরী, দৈত্য-দানব, পশু-পক্ষী এমনকি বাতাসের ওপরেও তাঁর প্রভুত্ব কায়েম ছিল । অথচ তিনি ছিলেন হযরত মূসা (আ)-এর অনুবর্তী। তাঁকে তওরাতের বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হত। তাতেই বোঝা যায়, কারামতের দিক দিয়ে হযরত হাবীব আজমী (র)-এর স্থান উচ্চ মনে হলেও ইলমে মারেফাত, হাকীকাত, তরীকতও শরীয়তের সামগ্রিক বিচারে হযরত হাসান বসরী (র)-এর স্থান শীর্ষে।

বিশ্বনন্দিত ইমাম শাফেয়ী (র) ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) একবার কোন এক স্থানে মিলিত হন। ঘটনাক্রমে সেখানে হযরত হাবীব আযমী (র)-ও উপস্থিত হন ৷ ইমাম হাম্বল (র) তাঁকে কিছু প্রশ্ন করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে ইমাম শাফেয়ী (র) বললেন ইনি অন্য ধরনের লোক। কিছু জিজ্ঞেস না করাই ভাল। কিন্তু ইমাম হাম্বল (র) প্রশ্নটা করেই বসলেন-কোন লোক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের এক ওয়াক্ত নামায আদায় করেনি। আর কোন ওয়াক্ত আদায় করনি, তাও তার মনে নেই। সেক্ষেত্রে সে কী করবে?

হযরত হাবীব আজমী (র) বললেন, মনে হয় লোকটা বড় বেশি ভ্রান্ত। তার কিছু শেখা দরকার। পুরো পাঁচ ওয়াক্ত নামাযই তাকে আদায় করতে হবে। এ জ্ঞানগর্ভ উত্তরে ইমামদ্বয় বিস্মিত হলেন।

মহাসাধকের ব্যবহারিক জীবনের বৈশিষ্ট্য মানুষকে আরো বেশি মুগ্ধ করে। প্রায় বিশ বছর ধরে একজন পরিচারিকা তাঁর সেবা করেছেন। অথচ তিনি কখনো তাঁর চেহারা দেখেননি । একদিন তিনি তাঁকেই বলেন, আমার পরিচারিকাকে ডেকে দাও দেখি। সে বলল, হুজুর, আমিই তো অপনার পরিচারিকা ।

দীর্ঘদিনের মধ্যে যার চোখ-মুখ-চেহারার দিকে একপলকও যিনি তাকাননি, তাঁকে তিনি চিনবেন কী করে?

মহাতাপস আল্লাহকে বলতেন, আপনাকে লাভ করে যে খুশি হতে পারেনি, সে যেন অন্য কিছু লাভ করেও খুশি হয় না। আপনার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, অন্যের প্রতি তার যেন আকষর্ণ না থাকে ।

আল্লাহর সন্তুষ্টি কিসে লাভ করা যায়? কেউ প্রশ্ন করেন। তাঁর উত্তর হৃদয়কে একাগ্র ও অকপট করতে হবে। পাক কালামের পাঠ শুনলেই তিনি কাঁদতেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হত আপনি তো আজমী । আর কুরআনের ভাষা আরবী। এর অর্থ না বুঝেই আপনি কাঁদেন কেন? তাঁর উত্তর: আমি আজমী ঠিকই। কিন্তু আমার অন্তর আরবীয়। এক সাধক একদিন তাঁর সম্পর্কে বলে ফেললেন, এ আজমী লোক এতদূর মর্যাদা অর্জন করল কি করে? সঙ্গে সঙ্গে তিনি দৈববাণী শুনতে পান। আজমী হলেও তিনি আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। এক খুনীকে হত্যাপরাধে শূলে দেয়া হয়। কিন্তু লোকে স্বপ্ন দেখে, সে দিব্যি দিব্যপোশাকে জান্নাতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন । এর কারণ জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, আমাকে যখন শুলে চড়ানো হয়, তখন ওদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন হযরত হাবীব আজমী (র)। তিনি আমার পারলৌকিক মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন । আর সে দোয়ার বরকতেই আমার এ জান্নাত বাস ।

গ্রন্থসূত্র – তাযকিরাতুল আউলিয়া
মূল – হযরত খাজা ফরীদুদ্দিন আত্তার নিশাপুরী
অনুবাদ – মাওলানা ক্বারী তোফাজ্জল হোসেন ও মাওলানা ক্বারী মোহাম্মদ হাসান
সিদ্দিকিয়া পাবলিকেশন্স

সাবস্ক্রাইব করুন

More Posts

Related articles