খলিফা হাশেম বিন আবদুল মালেক । তিনি মহা প্রতাপশালী, মহিমান্বিত। কিন্তু তিনিও এক মহাতাপসকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি শাসক শাসন কাজে নিযুক্ত থেকে আমি কিভাবে মুক্তি পেতে পারি?
মহাতাপস উত্তর দিলেন, আপনার প্রতিটি দিরহাম যেন সিদ্ধস্থান থেকে উপার্জিত হয়। আর তা যেন সিদ্ধস্থানে ব্যয় করা হয়।
তা কি সম্ভব?
খলিফার কুণ্ঠিত জিজ্ঞাসা।
জাহান্নামের ভয়ে যে ভীত আর জান্নাতের লোভে লালায়িত, আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন যার উদ্দেশ্যে, তার পক্ষে সেটি খুবই সহজ ও সম্ভব।
এ মহাপ্রাজ্ঞ সাধক হলেন হযরত আবু হাশেম মক্কী (র)। অত্যন্ত আল্লাহভীরু, ধর্মনিষ্ঠ একজন মানুষ। জগতের বহু উজ্জ্বল পুরুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ ঘটেছিল তাঁর। বিশেষ করে হযরত আনাস (রা) ও হযরত আবু হোরায়রা (রা) প্রমুখের সান্নিধ্য তাঁর ভবিষ্যত জীবনকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে ।
বহু বিদগ্ধ পণ্ডিত বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর জীবনালেখ্য রচনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হযরত আবু ওসমান মক্কী (র)।
তাঁর বক্তব্য ছিল, পার্থিব-কামনা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা, বিচার দিবসে পার্থিব বিষয়নিষ্ঠ ব্যক্তিদের সম্বন্ধে বলা হবে, যে বস্তুগুলোকে নিকৃষ্ট বলে আল্লাহ্ পাক নির্দিষ্ট করেন, এরা মনের আনন্দে সেগুলোকেই গ্রহণ করে । আজ এজন্য এদে কার্যকলাপকে আয়ের তলায় করা হল ।
হযরত আবু হাশেম সূফী (র) বলেন, পৃথিবীতে এমন কোন বিষয় বা বস্তু নেই, যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হয় না, ব্যগ্রতা বা অস্থিরতার শিকার হতে হয় না। তার কোন আনন্দময় পরিণতি নেই। তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর তুচ্ছতম বস্তুর প্রতি মানুষের আসক্তি পরকালের বৃহত্তম বস্তুসমূহ থেকে তাকে বঞ্চিত করে ।
তিনি বলেন, মানুষের জন্য দু’টি বিষয়ই মূল কথা। প্রথমটি হল, যে জিনিস তার জন্য সংরক্ষিত, তা সে পাবে। যদি তার থেকে সে দূরে পালিয়ে যায়, তবু তা পেছনে পেছনে ছুটে যাবে। দ্বিতীয়টি হল যা তার নয়, অন্যের জন্য রাখা হয়েছে, তা সে পাবে না। তার জন্য যত চেষ্টাই সে করুক, সে কিছুতেই তা পেতে পারে না ।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, মানুষ এমন এক যুগে উপনীত হয়েছে, যখন সে কাজের চেয়ে কথায় এবং আমলের চেয়ে বিদ্যায় বেশি সন্তুষ্ট। অতএব, বলতে হয়, সর্বোৎকৃষ্ট সময়ে অর্থাৎ রাসূলে করীম (স)-এর উম্মতের যুগে জন্মগ্রহণ করেও সে নিকৃষ্ট লোক হিসেবে গণ্য ।
তাঁকে প্রায়ই বলতে শোনা যেত, যে আল্লাহ্র ওপর খুশি, সে কখনো মানুষের কাছে কোন কিছুর প্রত্যাশা করে না ৷
একদিন তিনি চলেছেন এক কসাইখানার সামনে দিয়ে। তাঁকে দেখে কসাই বললে, মাল আছে নিয়ে যান । তিনি বললেন, আমার কাছে পয়সা নেই। কসাই বলল, তাতে কী, ধার নিয়ে যান। পয়সা হলে দেবেন। হযরত আবু হাশেম মাক্কী (র) বললেন, তার চেয়ে বরং প্রবৃত্তির কাছে কিছু সময় চেয়ে নেয়া ভাল । কসাই এবার কড়া ভাষায় বলল তাইতো পাঁজরের হাড় ক’খানা গোনা যায়। হযরত আবু হাশেম (র) তার উত্তরে বললেন, তবুও দেহে যতটুকু মাংস আছে, তাতে কবরের কীটগুলোর অনেক দিন চলবে ।
এ মহান সাধক সম্পর্কে কোন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছেন, তিনি হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে বাগদাদে গিয়ে শুনলেন যে, আবু হাশেম (র) বাগদাদে আছেন। তাঁর সাথে দেখা করার জন্য তিনি সেখানে গেলেন। আবু হাশেম (র) তখন ঘুমিয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পরে ঘুম থেকে জেগে উঠে তাঁকে দেখে বললেন, খুব ভালই হয়েছে। আমি এইমাত্র নবী-করীম (স) কে স্বপ্নে দেখলাম । তিনি আপনার সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন । আপনি আপনার মায়ের হক আদায় করুন। তাঁর সেবায় নিযুক্ত হোন। আপনার জন্য হজ্জ আদায় অপেক্ষা মায়ের সেবা ও হক আদায় করা খুব বেশি প্রয়োজন, সেটি উত্তমও বটে। কাজেই আপনি এ মুহূর্তে দেশে ফিরে যান । মায়ের সেবা-পরিচর্যা করুন। তাঁর দোয়া লাভ করুন ।
উক্ত জ্ঞানী ব্যক্তি বলেন, তারপর আমি আর মক্কা শরীফে না গিয়ে তাঁর পরামর্শমত দেশে ফিরে এলাম আর বৃদ্ধা জননীর সেবায় আত্মনিয়োগ করলাম ।
স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (স) আবু হাশেম মক্কী (র) কে যে মহামূল্য নির্দেশ দান করেন, তাতে তাঁর হৃদয়ের পবিত্রতা ও নবী-প্রীতির পরিচয় পাওয়া যায় ।
গ্রন্থসূত্র – তাযকিরাতুল আউলিয়া
মূল – হযরত খাজা ফরীদুদ্দিন আত্তার নিশাপুরী
অনুবাদ – মাওলানা ক্বারী তোফাজ্জল হোসেন ও মাওলানা ক্বারী মোহাম্মদ হাসান
সিদ্দিকিয়া পাবলিকেশন্স