মানুষের অন্তর একটি আয়নার মতো। যখন এটি পাপ, কামনা, হিংসা ও লোভে আচ্ছন্ন হয়, তখন সেই আয়না অন্ধকার হয়ে যায়। কিন্তু যখন এটি পরিশুদ্ধ হয়, তখন আল্লাহর নূর (আলো) তাতে প্রতিফলিত হয়। এই অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার প্রক্রিয়াকেই সুফিবাদের ভাষায় বলা হয় তাজকিয়া (Tazkiyah)।
তাজকিয়া মানে কেবল নৈতিক শিক্ষা নয়, বরং আত্মার গভীরে গিয়ে হৃদয়ের রোগগুলোকে দূর করা। ইসলামে এটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে, কুরআনে আল্লাহ বারবার বান্দার অন্তর পরিশোধনের উপর জোর দিয়েছেন।
আরবি শব্দ “তাজকিয়া” এসেছে “যাকা” থেকে, যার অর্থ হলো—পরিশোধন, বৃদ্ধি, পবিত্র করা।
তাজকিয়া মানে হলো—
১. হৃদয়কে ময়লা থেকে পরিষ্কার করা,
২. সৎ গুণাবলীকে বিকশিত করা,
৩. আল্লাহর কাছে নৈকট্য অর্জন করা।
আল্লাহ বলেন:
“নিশ্চয়ই সফল সে, যে তার নফসকে পরিশুদ্ধ করলো। আর ধ্বংস হলো সে, যে তা দূষিত করলো।” (সূরা আশ-শামস ৯১:৯-১০
“যে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে, আল্লাহ তাকে শান্তি দান করেন।” (সূরা আল-আ‘লা ৮৭:১৪)
রাসূল ﷺ বলেছেন:
“নিশ্চয়ই দেহের মধ্যে একটি অঙ্গ আছে, তা ভালো হলে পুরো দেহ ভালো হয়; তা খারাপ হলে পুরো দেহ খারাপ হয়। জেনে রাখো, সেটি হলো অন্তর।” (বুখারী, মুসলিম)
সুফিদের দৃষ্টিভঙ্গি
1. রাবেয়া বসরী (রহ.) বলেছিলেন: “হৃদয় যদি আল্লাহর প্রেমে ভরে যায়, তবে তার ভেতরে অন্য কোনো ময়লা থাকতে পারে না।”
2. ইমাম আল-গাজ্জালি (রহ.) লিখেছেন: “তাজকিয়া হলো রোগ সারানোর চিকিৎসা, আর শায়খ হলো সেই চিকিৎসক।”
3. রুমি (রহ.) বলেছেন: “হৃদয়কে পরিষ্কার করো, তবে তুমি দেখবে যে আল্লাহ আগে থেকেই সেখানে ছিলেন।”
হৃদয়ের রোগসমূহ (যা তাজকিয়ার মাধ্যমে দূর করতে হয়)
১. অহংকার – নিজেকে বড় ভাবা।
২. হিংসা – অন্যের ভালো দেখে দুঃখ পাওয়া।
৩. লোভ – অতি আসক্তি।
৪. রিয়া – নাম-যশ বা লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করা।
৫. গাফলত – আল্লাহকে ভুলে থাকা।
তাজকিয়ার ধাপসমূহ
১. মুরাকাবা (Self-awareness)
২. মুজাহাদা (Struggle)
৩. যিকর (Remembrance)
৪. সুফি শায়খের সঙ্গ
৫. ইহসান (Excellence in worship)
আজকের দুনিয়ায় মানুষ ভোগবাদ, অস্থিরতা, হতাশা ও মানসিক রোগে ভুগছে। এসবের মূল কারণ হলো হৃদয়ের অশুদ্ধি।
তাজকিয়ার মাধ্যমে—মানসিক শান্তি পাওয়া যায়, নেতিবাচক চিন্তা দূর হয়, সম্পর্ক উন্নত হয়,জীবনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়। যখন কেউ হিংসা থেকে মুক্ত হয়, তখন তার হৃদয় হালকা হয়। অহংকার ভাঙলে মানুষের প্রতি দয়া জন্মায়। লোভ দূর হলে সন্তুষ্টি আসে।
তাজকিয়া হলো আত্মার চিকিৎসা। যেমন শরীর অসুস্থ হলে ওষুধ দরকার হয়, তেমনি অন্তর অসুস্থ হলে দরকার হয় তাজকিয়ার। সুফিরা বলেছেন—“হৃদয় শুদ্ধ হলে সবকিছু শুদ্ধ হয়।”
তাজকিয়া শুধু সুফিদের জন্য নয়; এটি প্রতিটি মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ। কারণ হৃদয়ের আয়না পরিষ্কার না হলে আল্লাহর আলো সেখানে প্রতিফলিত হবে না। সুফি দৃষ্টিতে, তাজকিয়া মানে অন্তর থেকে ধুলো মুছে ফেলা, যাতে সত্যের আলো তাতে জ্বলে উঠে।