এক রূপসীর প্রেমে পড়ে গেলেন দারুণ, দুর্নিবার প্রেম। প্রচণ্ড আসক্তি। তার এ প্রেমের কথা অবশ্য গোপন না করে তিনি সুন্দরীর কাছে পৌঁছে দিলেন। রূপসী শুধু রূপসীই নন, পরম বিদূষীও বটে। তিনি তরুণের প্রেমাশক্তির খবর শুনে এক দাসীকে তাঁর কাছে পাঠালেন। যে তরুণের কাছে জেনে আসবে, তিনি তার দেহের কোন্ অঙ্গটি দেখে এতদূর আকৃষ্ট হলেন। দাসী তরুণ-সকাশে উপস্থিত হয়ে সে কথাটিই জিজ্ঞেস করে। তিনি বললেন, আমি তার অন্য অঙ্গ তো দেখিনি। শুধু চোখ দু’টিই আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ঐ চোখের আকর্ষণেই আরি প্রেমে পাগল হয়েছি। উত্তর নিয়ে দাসী ফিরে এল । আর সে রূপসী তরুণী করলেন কি, নিজের সে অনিন্দ্য সুন্দর চোক দু’টি উপড়ে ফেলে দাসীর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন তরুণের কাছে।
শিউরে উঠলেন তরুণ। এও কি সম্ভব? অথচ, শুধু সম্ভব নয়, সত্য। যার প্রতি তার প্রগাঢ় আসক্তি, তিনি কেমন অবলীলাক্রমে তাঁর অমূল্য নয়নমণি তাঁকে উপটৌকন দিলেন। বিপুল ভাবান্তর সৃষ্টি হল তাঁর মনে । মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবী মিথ্যে হয়ে গেল। হায় আসক্তি। মানুষকে তুমি কোথায় নামিয়ে দাও! কাল-বিলম্ব না করে তিনি ছুটলেন হযরত হাসান বসরী (র)-এর কাছে। আর তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। শুরু হয়ে গেল তাঁর কঠোর জীবন-সাধনা এবং অনন্ত করুণাময়ের অশেষ ইচ্ছায় একদিন তিনি সিদ্ধি লাভ করলেন। সফলকাম এ সাধকের নাম হযরত উৎবা বিন গোলাম (র)। হযরত হাসান বসরী (র)-এর মুরীদ এক উজ্জ্বল ভক্ত।
যেমন গুরু, তেমনি শিষ্য । সাধনার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে তিনি যা ইচ্ছা করতেন, আল্লাহর রহমতে তাই করতে পারতেন। একদিন স্বয়ং গুরু দেখতে পেলেন, হযরত উৎবা বিন গোলাম (র) দিব্যি পানির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অবাক হয়ে তিনি শিষ্যকে জিজ্ঞেস করলেন, এ ক্ষমতা তুমি কোথায় পেলে? শিষ্য উৎবা বিন গোলাম (র) বললেন, আপনি আমাকে যা নির্দেশ দেন, আমি মনে-প্রাণে তা পালন করি। তাছাড়া আপনি তো এ কাজগুলো ত্রিশ বছর আগে করতেন । আল্লাহ্ পাকের অসীম করুণায় আমি এখন এগুলো করতে পারি।
তিনি ছিলেন এক চাষী। নিজেই চাষবাস করতেন। নিজের হাতে গম পেশাই করে রুটি বানাতেন। একখানি মাত্র রুটি খেয়ে এক সপ্তাহব্যাপী আল্লাহ্র উপাসনায় মগ্ন হয়ে যেতেন। তিনি বলতেন, আমার দু’কাঁধে দু’ফেরেশতা কিরামুন-কাতেবীনের পাপ পূণ্যের হিসাব লেখার কথা মনে পড়লেই আমার মনে লজ্জা আসত ।
তাঁর বিমল হৃদয়ে আল্লাহ্ প্রেম ও ভীতির কিরূপ স্থান ছিল, তা একটি ঘটনায় জানা যায়। তখন শীতকাল । কনকনে শীত নেমেছে। একদিন দেখা গেল, মাত্র একটি জামা গায়ে চড়িয়ে হযরত উৎবা বিন গোলাম (র) বিমর্ষমুখে দাঁড়িয়ে আছেন এক প্রতিবেশীর বাড়ির দেয়ালের কাছে। ভীষণ শীতেও তাঁর গায়ের জামাটি ভিজে উঠেছে ঘামে। এভাবে এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, কিছুদিন আগে তাঁর বাড়িতে কয়েকজন অতিথি এসেছিলেন। খাবারের পর তাঁরা হাতের তেল-চর্বি ছাড়াবার জন্য ঐ দেয়ালের কিছু মাটি খসিয়ে নিয়ে হাত মর্দন করেন। তারপর পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেন। কিন্তু বাড়ির মালিকের অনুমতি নেয়া হয়নি। তিনি অবশ্য প্রতিবেশীকে সে কথা জানিয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। কিন্তু তবুও কী যে হয়, এখান দিয়ে গেলেই তাঁর অপরাধ বোধ জেগে ওঠে। মনে হয়, বিনা অনুমতিতে দেয়ালের মাটি ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। এ অন্যায় কাজের জন্য রোজ কিয়ামতে আল্লাহ্ যদি বলে ফেলেন, তাঁর অতিথী যখন এ কাজ করেছে, তখন এর জন্য তিনিই দায়ী । তখন কী উত্তর দিবেন, এ ভয়েই তিনি বিবর্ণ হয়ে যান ।
হযরত উৎবা বিন গোলাম (র) ছিলেন ধ্যান-মগ্নতা বা ভাব-তন্ময়তার প্রতীক, প্রতিমূর্তি । জনবহুল রাস্তার মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে তিনি এসেছেন হযরত আবদুল ওয়াহেদ বিন যায়েদ (র)-এর কাছে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় আপনার কার কার সাথে দেখা হয়েছে? তিনি নির্দ্বিধায় বললেন, না, কারোর সঙ্গেই আমার দেখা হয়নি।
অর্থাৎ আত্মমগ্ন অবস্থায় তিনি জনাকীর্ণ বাজার পেরিয়ে এসেছেন।
একদিন তাঁর মা বললেন, নিজের দিকে একটু যেন আমার দেহ-মনের কিছু সুখ-শান্তিরও প্রয়োজন আছে। তার জবাবে তিনি বললেন, মা, বিচার দিবসে দেল তোমার দেহ ও মনের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়, এ আমার ইচ্ছা। কেননা, তা চিরস্থায়ী হবে। জগৎ-সংসার তো শুধু জগৎ-সংসারের জন্য। এখানে সাময়িক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে যদি অনন্তকালের সুখশান্তি অর্জন করা যায়, তবে তার চেয়ে আর সৌভাগ্যের কী আছে? খুব সাদাসিধে মানুষ ছিলেন তিনি। খাবার-দবার কিংবা বেশভূষার প্রতি কোন মনোযোগ ছিল না। বস্তুত কৃচ্ছসাধানার মধ্যে দিয়ে তাঁর জীবন কেটেছে। তাঁর আল্লাহ্প্রেম ছিল নিষ্কাম। একবার সারা রাত জেগে আল্লাহর কাছে যে প্রার্থনা জানান, তার ভাষা ছিল এরকম-প্রভু গো, আপনি আমার কল্যাণ করুন, আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখব। আর যদি শাস্তি দেন, তবুও আমার বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। কখনো কোন অবস্থায়ই এ বন্ধুত্বের বন্ধন ছিন্ন হবে না ।
এক রাতে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, জান্নাতের এক হুর এসে তাঁকে বলছেন, উৎবা বিন গোলাম (র), আমি তোমার ওপর আসক্ত। তাই অনুরোধ, কখনো এমন কাজ করো না, যা তোমার ও আমার মধ্যে বিচ্ছেদের কারণ হতে পারে। হযরত উৎবা বিন গোলাম (র) স্পষ্ট ভাষায় উত্তর দিলেন, আমি তো আল্লাহ্ প্রেমে বিভোর হয়ে দুনিয়া বজর্ন করেছি। অতএব আপনার প্রতি কি দৃষ্টি দিতে পারি? অনুরুদ্ধ হয়ে কখনো কখনো তিনি তাঁর অলৌকিক শক্তির পরিচয়ও দিয়েছেন । একজনের অনুরোধ ছিল, তাঁকে কিছু খুরমা যোগাড় করে দিতে হবে। সাথে সাথে তাঁর থলে থেকে কিছু টাটকা খুরমা তাঁকে বের করে দেন। তাঁর অন্তিম মুহূর্তটি বড় বিস্ময়কর।
হযরত উৎবা বিন গোলাম (র)-এর ইন্তেকালের শ্রেষ্ঠ তাপসী হযরত রাবেয়া বসরী (র)। তাঁর কাছে বহু সাধকের নিত্য যাতায়াত ছিল । একদিন তাঁর দরবারে উপস্থিত রয়েছেন সাধক সাম্মাক (র) ও হযরত যুননুন মিশরী (র)। হঠাৎ সেখানে হাজির হলেন হযরত উৎবা বিন গোলাম (র)। আজ পরণে মামুলী পোশাক নয়; বরং পরিপাটি পোশাক পরিহিত অবস্থায় রয়েছেন। তাঁর দিকে চোখ রেখে হযরত সাম্মাক (র) বললেন, আপনাকে দেখে কিছুটা দেমাকী মনে হচ্ছে। হযরত উৎবা বিন গোলাম (র) বললেন, তা হতেই পারে। আমি এক অধম দাস। কিন্তু তবুও মহাপ্রতাপশালী আল্লাহর দাস । অতএব তাঁর কি কোন প্রভাবই আমার মধ্যে পড়বে না? একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভূতলশায়ী হলেন। সবাই তাঁর কাছে এসে দেখলেন, তিনি তাঁর মহাপ্রতাপশালী প্রতিপালকের কাছে চলে গেছেন ।
পরে এক পবিত্র-হৃদয়ের মানুষ স্বপ্নে দেখেন, হযরত উৎবা বিন গোলাম (র)-এর চেহারার আধখানা কালো দেখাচ্ছে। এর কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ছাত্রজীবনে তিনি একটি রূপলাবণ্যময় বালকের চেহারায় আকৃষ্ট হন। মৃত্যুর পর যখন তাঁকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন এক বিষধর সাপ বেরিয়ে এসে তাঁকে দংশন করে বলল, সেদিনের সে দৃষ্টির এ হল শাস্তি । তিনি যদি আবার তাঁর দিকে দৃষ্টি দিতেন, তাহলে তাঁর শাস্তি আরো কঠোর তাঁর এ শাস্তির বিবরণও মানুষের টনক নড়িয়ে দেয়।
গ্রন্থসূত্র – তাযকিরাতুল আউলিয়া
মূল – হযরত খাজা ফরীদুদ্দিন আত্তার নিশাপুরী
অনুবাদ – মাওলানা ক্বারী তোফাজ্জল হোসেন ও মাওলানা ক্বারী মোহাম্মদ হাসান
সিদ্দিকিয়া পাবলিকেশন্স