হযরত ওয়াসে (র) মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন, হে প্রভু! আপনি আপনার প্রিয় বন্ধুগণের ন্যায় আমাকেও অভাবগ্রস্ত করে রেখেছেন। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না, আমার কোন গুণে মুগ্ধ হয়ে আপনি আমাকে এ মর্যাদা দান করেছেন ?
প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে এক মহান তাপসের এ মোনাজাতে স্পষ্ট হয়, দারিদ্র্যকে তিনি কী উচ্চ মর্যাদায় মহিমান্বিত করেছেন। অভাবগ্রস্ত হওয়াও মানুষের একটি গুণের মর্যাদা-একথা তিনিই পরম গভীর অনুরাগে উচ্চারণ করেন।
হযরত ওয়াসে (র) সে যুগের এক প্রখ্যাত আলেম ও সাধক ছিলেন। সারা জীবন শুধু শুকনো রুটি পানিতে ভিজিয়ে খেয়েছেন। অন্য কোন সুস্বাদু উত্তম মুখরোচক খাদ্য গ্রহণ করেননি । তিনি বলতেন, যারা এরূপ আহার করে, তাদের কখনো অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয় না ৷
তাঁর জীবনে এমন বহুবার হয়েছে যে, হয়তো দু’চারদিন চলে গেল, কিছুই খাবার জুটল না। হযরত হাসান বসরী (র)-এর দরবারে তাঁর যাতায়াত ছিল। তাঁকে দেখে হযরত হাসান বসরী (র) খুব বেশি খুশি হতেন। সেখান থেকে কিছু খেয়ে আসতেন মাঝে মাঝে ।
হযরত ওয়াসে (র) সম্পর্কে হাসান বসরী (র) বলতেন, তাঁর মতো ভাগ্যবান ব্যক্তি আর নেই, যিনি পেটে ক্ষুধা নিয়ে সকালবেলায় বিছানা থেকে ওঠেন আর ক্ষুধা নিয়েই রাতের বেলায় বিছানায় যান। আর এত কষ্ট সত্ত্বেও আল্লাহর উপাসনায় বিমুখ হন না ৷
পরমুখাপেক্ষী আর পরনির্ভশীল না হওয়াকেই তিনি বলতেন প্রকৃত বাদশাহী। তাঁর কথা, তুমি যদি বেলায়েতের অধিকারী হতে চাও এবং কারো কাছ থেকে কোন কিছু প্রত্যাশা না কর আর সৃষ্টিজগৎকে একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করতে পার তাহলে তোমাকে আর কারো মুখাপেক্ষী হতে হবে না, কারো প্রতি কোন কাজে নির্ভরও করতে হবে না ।
হযরত মালেক দীনার (র)-এর সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পার্থিব-জীবনে ধন-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ অপেক্ষা রসনা সংযত করাই কঠিন ।
প্রখ্যাত সাধক কাতীবা (র)-এর সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। একদিন তিনি তাঁর দরবারে হাজির হন অতি সাধারণ জীর্ণ পোশাকে । হযরত কাতাবী (র) তাঁর পোশাকের অবস্থা দেখে বলেন, আপনি এমন পোশাক পরেছেন কেন? হযরত ওয়াসে (র) কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকেন। তিনি আবারও বলেন, কী হল! কথা বলছেন না যে! এবার তিনি বলেন, আপনার প্রশ্নের উত্তর কী দেব। ভেবে পাচ্ছি না। আমি উভয় সঙ্কটে পড়েছি। যদি বলি দরবেশ- ফকীরের পোশাক এরূপ সাদাসিধে অনাড়ম্বর হওয়া উচিত, তাতে একটা অহমিকার ভাব ফুটে ওঠে। আবার যদি বলি আল্লাহ্ আমাকে দামী পোশাক পারার তওফিক দেননি, তিনি যেভাবে রেখেছেন সেভাবে সেরকম পোশাক পরে আছি। তাতেও মনে হয় আল্লাহর ওপর কিছু অভিমান-অভিযোগ প্রকাশ পায় । তাই আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করি ।
অর্থাৎ, সামান্যতম অহমিকাও তাঁকে বিব্রত করত। আর বিলাসিতার ব্যাপারটি মোটেই চিন্তা করতে পারতেন না । তাঁর পুত্রের মধ্যে অহমিকা ও বিলাসিতার কিছু আভাস পেয়ে তাঁকে কাছে ডেকে তিনি বলেন, তুমি কে, তা কি তুমি জান? তোমার মাকে মাত্র দু’শ দিরহাম দিয়ে বিয়ে করে এনেছি। আর আমি তোমার পিতা সকলের চেয়ে এক অধম মুসলমান। আল্লাহর এক দীনতম দাস। দাসানুদাস ৷ এখন ভেবে দেখ, মা-বাবা যার তুচ্ছতম দাস-দাসী, তাদের সন্তান হয়ে অহঙ্কার প্রকাশ করা কি তোমার শোভা পায়?
একটা লোক তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, হুজুর, আপনি ভাল ও সুস্থ মনে আছেন তো? তিনি জবাব দেন, প্রতি মুহূর্তে জীবনের আয়ু ক্ষয় হয়ে চলেছে। কিন্তু পুণ্য বলতে কিছু নেই; বরং পাপের পরিমাণ বেড়েই চলেছে । এ অবস্থায় কি ভাল থাকা যায়? না মনে-প্রাণে সুস্থ থাকা সম্ভব?
হযরত ওয়াসে (র) প্রায়ই বলতেন, আমি সব জিনিসের মধ্যেই আল্লাহর নিদর্শন দেখি আপনি কি আল্লাহকে চিনেছেন? তাঁকে প্রশ্ন করা হয়। তিনি কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকেন। তারপর বলেন, আল্লাহকে যে চিনেছে, সে-ই নির্বাক ও নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহকে চিনবার পর মানুষ আর বেশি কথা বলতে পারে না। আর আল্লাহর অশেষ ইচ্ছায় যার মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে, সে কখনো আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো দিকে ফিরেও দেখে না।
তিনি আরো বলেন, কেউ কোনদিন প্রকৃত বিশ্বাসী হতে পারে না, যতদিন না তার মনে আশা ও নিরাশা সমানভাবে বিরাজ করে ।
বহু ওলী-দরবেশের সংস্পর্শ-ধন্য মহান আল্লাহ্প্রেমী এ সাধক আধ্যাত্ম-জগতের এক বিস্ময়কর আদর্শ হিসেবে আলোকস্তম্ভের মত মানুষের মনোলোকে বিরাজ করছেন।
গ্রন্থসূত্র – তাযকিরাতুল আউলিয়া
মূল – হযরত খাজা ফরীদুদ্দিন আত্তার নিশাপুরী
অনুবাদ – মাওলানা ক্বারী তোফাজ্জল হোসেন ও মাওলানা ক্বারী মোহাম্মদ হাসান
সিদ্দিকিয়া পাবলিকেশন্স