হৃদয় শুধু রক্তপাম্প করার অঙ্গ নয়—এটি এক আধ্যাত্মিক কেন্দ্র। সুফিরা বিশ্বাস করেন, আল্লাহর নূর বা আলো সবচেয়ে আগে বান্দার হৃদয়েই অবতীর্ণ হয়। তবে সেই হৃদয়কে শুদ্ধ করা, সঠিক পথে পরিচালিত করা এবং আল্লাহর প্রেমে ভরিয়ে তোলা সহজ কাজ নয়। এজন্য প্রয়োজন হয় এক আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শকের। সুফি পরিভাষায় এই আধ্যাত্মিক সংযোগের নাম হলো তাওজ্জুহ (Tawajjuh)।
তাওজ্জুহ হলো সেই রহস্যময় সেতু, যার মাধ্যমে একজন শায়খ (মুর্শিদ) তার মুরীদ (শিষ্য)-এর হৃদয়ে নূর, শক্তি এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রবাহিত করেন।
তাওজ্জুহ কী?
তাওজ্জুহ শব্দের অর্থ দৃষ্টি, মনোযোগ বা অভিমুখ। সুফি প্রেক্ষাপটে এর মানে হলো—শায়খের আত্মিক মনোযোগ, যা মুরীদের অন্তরে আধ্যাত্মিক পরিবর্তন ঘটায়।
সহজভাবে বোঝার জন্য, শায়খের হৃদয় হলো সূর্যের মতো, মুরীদের হৃদয় হলো চাঁদের মতো, তাওজ্জুহ হলো সেই আলো, যা সূর্য থেকে চাঁদে প্রতিফলিত হয়ে অন্ধকার দূর করে।
আল্লাহ বলেন:
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সৎ লোকদের সঙ্গ দাও।” (সূরা তওবা ৯:১১৯)। সৎ লোকদের সঙ্গ মানে শুধু শারীরিক সঙ্গ নয়, বরং তাদের আত্মিক প্রভাবও গ্রহণ করা। এটিই তাওজ্জুহের মূল।
রাসূল ﷺ বলেছেন:
“সৎ লোকের সঙ্গ হলো সুগন্ধি বিক্রেতার মতো। তুমি যদি তার কাছ থেকে কিছু না-ও কিনো, তবুও তার সুগন্ধ তোমাকে ছুঁয়ে যাবে।” (বুখারী, মুসলিম)। এখানেই বোঝা যায়, শায়খের অন্তরের আলো মুরীদকে আলোকিত করে, যদিও সরাসরি কোনো শিক্ষা না-ও দেওয়া হয়।
সুফিদের দৃষ্টিভঙ্গি
1. খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (রহ.) বলেন: “শায়খের এক দৃষ্টি মুরীদের অন্তর এমনভাবে পাল্টে দিতে পারে, যা বছরের সাধনা দিয়েও সম্ভব নয়।”
2. রুমি (রহ.) লিখেছেন: “প্রেমিকের চোখ প্রেমিকাকে যেমন আলোকিত করে, শায়খের তাওজ্জুহও মুরীদের হৃদয় আলোকিত করে।”
3. আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) বলেন: “তাওজ্জুহ হলো আল্লাহর রহমতের দরজা খোলার চাবি।”
তাওজ্জুহের ধাপ
1. শুরু (Initiation): যখন মুরীদ প্রথমবার শায়খের কাছে আসে, তখন তিনি দোয়া ও দৃষ্টির মাধ্যমে তার অন্তর পরিশুদ্ধ করেন।
2. নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ (Continuous Tawajjuh): শায়খের নজর, যিকর ও শিক্ষার মাধ্যমে মুরীদ ধীরে ধীরে আধ্যাত্মিক অগ্রগতি লাভ করে।
3. সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ (Total Alignment): একসময় মুরীদের হৃদয় শায়খের সাথে এমনভাবে যুক্ত হয় যে, তার ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা মুর্শিদের ইশারায় রূপ নেয়।
তাওজ্জুহ বনাম শিক্ষা
অনেকে ভাবেন, কেবল বই পড়েই আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করা যায়। কিন্তু সুফিরা বলেন—বই জ্ঞান দেয়, তাওজ্জুহ প্রাণ দেয়। যেমন: মোমবাতি জ্বালাতে ম্যাচস্টিক দরকার। বই হলো মোমবাতি, আর তাওজ্জুহ হলো সেই ম্যাচস্টিক, যা আলো জ্বালিয়ে দেয়।
আধুনিক জীবনে তাওজ্জুহের প্রয়োগ
আজকের ব্যস্ত জীবনে শায়খের শারীরিক সান্নিধ্য সবসময় পাওয়া যায় না। কিন্তু তাওজ্জুহ কেবল মুখোমুখি দৃষ্টি নয়, বরং হৃদয়ের সংযোগও। যখন মুরীদ দূর থেকে শায়খকে স্মরণ করে, যখন তার যিকর, উপদেশ মনে করে, তখনো এক ধরণের তাওজ্জুহ ঘটে যায়।
বাস্তব উপকারিতা
মানসিক শান্তি লাভ, নেতিবাচক চিন্তা কমে যাওয়া, আল্লাহর প্রতি গভীর ভক্তি তৈরি হওয়া, জীবনে শৃঙ্খলা ও ইতিবাচকতা আসা।
উপসংহার
তাওজ্জুহ হলো এক অদৃশ্য শক্তি, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সুফিদের হৃদয় আলোকিত করেছে। একজন শায়খের দৃষ্টি মুরীদের অন্তরে এমন আলো জ্বালায়, যা বই-পুস্তকের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব নয়।
সুফি দৃষ্টিতে, তাওজ্জুহ মানে আত্মার বিদ্যুৎ সংযোগ—শায়খ হলো তার উৎস, আর মুরীদ হলো সেই বাতি, যা এই আলোয় আলোকিত হয়।