লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
কালের পরিক্রমায় অন্যান্য সকল ধর্মের মতোই মোহাম্মদী ইসলামের ওপরও পতিত হয়েছে ধর্মহীন অসুরচক্রের কালো হাত। যারা ধর্মের অভ্যন্তরে বাস করে ধার্মিক সেজে বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে ধর্মের। মহানবী (সা) এর জীবৎকালে পরাজয়ের নিদারুন জ্বালা বুকে লুকিয়ে রেখে বিষ-জিহ্বা মুখে পুরে যারা শামিল হয়েছিল ইসলামের পতাকাতলে, তারা নবী (সা) এর দেহত্যাগের মুহুর্ত হতেই শুরু করে দেয় তাদের বৈরী আচরণ। পর্দার অন্তরাল থেকে বেড়িয়ে আসে তাদের চিরাচরিত কদর্য রূপ। তখন থেকেই তারা মেকী ধার্মিকতার আড়ালে শুরু করে ইসলামকে জীবন্ত কবর দেয়ার দূরভিসন্ধি। রাষ্টীয় ক্ষমতা বরাবরই ছিল তাদের দখলে। মূল ইসলামকে জগৎ হতে চির বিসর্জন দেয়ার নিমিত্তে সেই মুনাফিক গোষ্ঠী (যারা বরাবরই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ) ইসলামের প্রতিটি পবিত্র সার্বজনীন এবং মানব মুক্তির বিধান কে করেছে রদবদল। প্রকৃত ইসলামকে লুকিয়ে প্রচার করেছে তাদের তৈরী এক ইমিটেশন মার্কা অপ-ইসলাম।
তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময়ে উদ্ভুত ধর্মের ছদ্মাবরণে বাস করা বিভিন্ন অপশক্তি বার বার ইসলামের তথা চিরমুক্তির পবিত্রতম বিধান আত্মসমর্পন তথা বাইয়াতের বিধান নিয়ে তৈরী করে যাচ্ছে নানা রকম বিতর্ক।
দ্বীন ইসলাম একটি সার্বজনীন বিধান। চিরন্তন এবং শ্বাশত কালের ধর্ম। যেখানে স্বয়ং খোদা প্রতিটি যুগে যুগে প্রতিটি কওম বা জাতিতে প্রতিটি ভাষায় রাছুল পাঠাচ্ছেন পতিত মানব সমাজকে সত্য সুপথ দেখানোর জন্য। যারা যুগের রাছুল বা ইমাম কে লাভ করতে সক্ষম হচ্ছেন তারাই পাচ্ছেন সত্য সুপথ আর যারা শয়তানের প্ররোচনায় প্রেরিত মানুষ গুরু তথা রাছুলদেরকে অস্বীকার করে মিথ্যা কল্পনায় শূণ্যে অবস্থিত কোনো অদৃশ্য সত্ত্বার ইবাদত করছেন তারাই হচ্ছেন পথভ্রষ্ট। এক শ্রেণীর মোল্লা-মৌলবীগন তাদের অপশিক্ষার জোরে সমাজে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন যুগের রাছুলকে অস্বীকার করে অদৃশ্য আল্লাহর ইবাদত করলে নাকি জান্নাত লাভ করা যাবে। এরা ইবশিলের যোগ্য উত্তরসূরী। যুগে যুগে ধর্মবিধান প্রচার হচ্ছে আল্লাহ প্রেরিত অবতার বা মুক্ত পুরুষদের মাধ্যমে। যাদের আমরা বলি শুরু বা মুর্শিদ বা পীর। এদের দেখানো পথে চলাই ধর্ম। বাকী সব অধর্ম।
গুরু,মুর্শিদ বা পীর যিনি যুগে যুগে আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি বলে মানুষকে পথ দেখায় তার অনুসরণকারীকে বলা হয় মুসলমান। বাকীদেরকে মুসলমান হতে বলা হচ্ছে মুর্শিদের অনুসরণ করে।
প্রতিটি মুসলমানের প্রতিদিনের অবশ্যপাঠ্য কালাম সুরা ফাতেহায় সে প্রার্থনাই করা হচ্ছে “তোমার নিয়ামত প্রাপ্ত যারা তাদের পথে আমায় পরিচালিত করো” বলে।
জেনে রাখা দরকার, ইসলাম কোনো পৈত্রিক ধর্ম নয়। বাপ দাদার দেখাদেখি ধর্ম করলে সেটাকে ধর্ম বলা যাবে না। ইসলামে প্রবেশ করতে হবে আল্লাহর অনুমতি নিয়ে আল্লাহর দেখানো পথে অর্থাৎ পীর মুর্শিদ বা গুরু তথা রাছুল সত্ত্বার অধিকারী মুক্ত ও পবিত্র মানুষের হাতে হাত রেখে বাইয়াত তথা অঙ্গীকার গ্রহণ করে নিজেকে সমর্পন তথা বিলীন করে দিয়ে। নতুবা তাকে মুসলিম বলে স্বীকৃতি দেয়া যাবে না।
জেনে রাখা দরকার-বাইয়াত শব্দের আভিধানিক অর্থ বিক্রি হওয়া। আনুগত্য স্বীকার করা, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া ইত্যাদি। ব্যবহারিক অর্থে “বাইয়াত মানে হলো রাছুলের নিকট তথা ইনছানুল কামেল বা ওলী, মুর্শিদের নিকট আমিত্ব সমর্পন করে সম্পূর্ণরুপে ধর্মে দাখিল হওয়া।”
যুগের রাছুল বা প্রেরিত মুর্শিদ গুরুর অনুসরণেই আসবে কাক্সিক্ষত মুক্তি ও প্রতিপালিত হবে ধর্ম। মানবমুক্তির বিধান কোরআনে এর বারংবার স্পষ্ট আদেশ থাকলেও এক শ্রেণীর স্বার্থান্ধ বা তথাকথিত মোল্লা-মৌলবী নামধারী গোঁয়ার গোবিন্দদের অপপ্রচারের ফলে বাইয়াত এর স্পষ্ট বিধানটি জনসম্মুখে বিতর্কিত বলে উপস্থাপিত হচ্ছে।
চলুন, কোরআনের আয়াতগুলো দেখে আসা যাক-
সুরা নাহল ৩৬, সুরা ইব্রাহিম ০৪, সুরা রাদ ০৭, সুরা ফাত্তাহ ১৯,২৯, সুরা নিসা ১৩, ৮০, ১৫০,১৫১, সুরা ইমরান ৩১, ৩২, ১৩২, সুরা হুজরাত ০২, সুরা তওবা ৬৯, সুরা আহযাব ৩৬, ০৬, ৫৬, সুরা নূর ৩৫, ৬২, ৬৩, সুরা মুমিনুন ২৪, সুরা ফুরকান ৫৯, সুরা ইউনুস ৪৭,১০০, সুরা কাহাফ ৭০, সুরা বাকারা ১৫৪, সুরা আরাফ ১৮১, ১৯৮ ইত্যাদি।
ইসলাম ধর্ম আত্মসমর্পনের ধর্ম। যেখানে নিজের আমিত্বকে পুরোপুরি ত্যাগ করে ওলী, গুরু, মুর্শিদ বা পীরের নিকট বাইয়াত গ্রহন করে নফসানিয়াতের খায়েশমুক্ত পবিত্র জীবন যাপন করতে হয়। সমগ্র কোরআন জুড়েই যার স্পষ্ট বিধানাবলী এবং দলিল উপস্তিত। যেমন-আল্লাহপাক রাছুল (সা) কে বলছেন, হে রাসুল আপনার হাতে হাত দিয়ে যারা বায়াত গ্রহন করে তারা নিশ্চয়ই আল্লাহর হাতে হাত দিয়ে বায়াত হয়। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর। (ফাত্তাহ ১০)। এবং এ বায়াত যারা ভঙ্গ করে তাদের জন্য আল্লাহ উচ্চারণ করেছে কঠোর হুশিয়ারী। বাইয়াত গ্রহণকারীদের ওপর আল্লাহ সন্তষ্ট বলে জানিয়ে দিচ্ছেন (সুরা ফাত্তাহ ১৮) নং আয়াতে।
আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য উসিলা অন্বেষণের আদেশ দেয়া হচ্ছে কোরআনে। (সুরা মায়েদা ৩৫) আয়াত।
আল্লাহর রাব্বুল আলামিন মুসা নবীকে বেলায়েতের গোপন রহস্য/ইলমে লাদুন্নী জানার জন্য পাঠালেন হযরত খিজিরের নিকট এবং নবী হযরত খিজিরের নিকট বাইয়াত হলেন। (সুরা কাহাফ ৬৬-৬৯)।
(সুরা নিসা ৫৯) আয়াত আল্লাহ স্পষ্ট বলছেন যুগের কামেলীন পীরের তথা উলিল আমরের আনুগত্য করতে। কামেলীনদের স্বান্নিধ্যকে উত্তম বলা হয়েছে কোরানে। (নিসা ৬৯)।
আল্লাহ পাক তাদের অনুসরণ করতে বলছে যারা মানুষের নিকট কোনো বিনিময় কামনা করে না অথচ তারা সুপথ প্রাপ্ত (সুরা ইয়াসিন ২১)। বিশুদ্ধ চিত্তে যে সকল মহাপুরুষ আল্লাহর অভিমুখি হয় তথা ওলী আউলিয়া হয় তাদের অনুসরণ করার জোর করার তাগিদ দেয়া হচ্ছে কোরানে (সুরা লোকমান ১৫)।
হাশরের মাঠে যখন প্রত্যেককে তাদের নেতাসহ আহ্বান করা হবে (সুরা বনী ইসরাইল ৭১) তখন আপনাপন মুর্শিদের পতাকা তলেই দাড়াবে ঈমানদারগণ। অনুমান কল্পনা সেদিন কোনো কাজেই আসবে না।
আল্লাহ যাকে পথহারা করেন সে মুর্শিদের সন্ধান পায় না (সুরা কাহাফ ১৭)।
প্রতিশ্রুতি প্রাপ্তরা হাশরের সুপারিশ করতে পারবে (সুরা মারঈয়াম ৮৭)। তোমরা যদি না জানো তবে যে/যারা জানেন তাদের নিকট হতে জেনে নাও (আম্বিয়া ৭)। হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সাদেকিন/সত্যবাদীদের সঙ্গী হও (তাওবা ১১৯)। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক এর রহমতে আউলিয়া কেরামের নিকটবর্তী (আরাফ ৫৬)।
সাবধান, আল্লাহর অলিগনের ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও নহে (ইউনুস ৬২)। হে নবী, আপনার নিকট যদি নারীরা এ শর্তে বাইয়াত হতে আসে যে তারা শিরক করবে না, চুরি, যিনা, সন্তান হত্যা করবে না, অপবাদ রচনা করবে না, ন্যায্য ব্যাপারে আপনার অবাধ্যতা করবে না, তা হলে আপনি তাদের বাইয়াত কবুল করুন (মুমতাহিনা ১২)।
পীর কে আরবীতে বলা হয় মুর্শিদ যার অর্থ পথপ্রদর্শক। এদেরকেই উম্মতের শ্রেষ্ঠ দল বলা হচ্ছে সুরা আরাফের ১৮১ নং আয়াতে । যাদের অনুসরণের মাধ্যমেই প্রত্যেককে পূর্নরূপে ইসলামে দাখেল হতে বলা হচ্ছে কোরানে। যার পথপ্রদর্শক নেই তার পথপ্রদর্শক হলো শয়তান। এবং চিরকাল ধরে শয়তানের অনুসারীরাই মুক্তিদাতা মুর্শিদের তথা বাইয়াতের বিরুদ্ধে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের অপপ্রচার।
মকতুবাতে সাদী কিতাবে বলা হয়েছে “উম্মতের জন্য যেমন নবী, কওম বা জাতির জন্য তেমন শায়েখ বা মুর্শিদ”।
বাইয়াতবিহিন ব্যক্তির মৃত্যুকে জাহিলিয়াতের মৃত্যু বলা হয়েছে পবিত্র হাদিস শরীফে বোখারী এবং মেশকাত)। আরো বলা হয়েছে বায়াত ভঙ্গকারীর পরিণাম জাহান্নাম (বোখারী )। বায়াত ভঙ্গকারীর দিকে আল্লাহ তাকাবেন না (বোখারী)। শত শত হাদিসে উল্লেখ রয়েছে সাহাবীদের বাইয়াতের নজীর। উম্মতের সকল গাউস কুতুব পীর মাশায়েখ ওলী আউলিয়া সকলেই বাইয়াত গ্রহণ করেছেন ও উম্মতের থেকে বাইয়াত নিয়েছেন। বাইয়াত প্রসঙ্গে তাদের বাণীসমূহ উল্লেখ করলে রীতিমতো একটা কিতাব হয়ে যাবে।
উম্মতের মধ্যে একদল মুনাফিক যারা মূলতঃ মুয়াবিয়া এজিদ বা আবু জাহেল আবু লাহাবের প্রেতাত্মা তারাই দ্বীন ইসলামের শাশ্বত বিধান বাইয়াতের শানে জাল হাদিসের সম্ভার সাজিয়ে বিভিন্ন ভাবে কু-প্ররোচণামূলক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য দিয়ে থাকে। এরা ধর্মবিরোধী চক্র যারা ধর্মের প্রকৃত চিরন্তন শান্তির রূপকে কদর্যমন্ডিত করার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার নিমিত্তে বাইয়াতের তথা ওলী মুর্শিদ বা পীর গুরুদের বিরুদ্ধে হীন অপপ্রচার চালাচ্ছে।
দেশ ও জাতিকে তাদের অপপ্রচার থেকে সাবধান থাকার জন্য অনুরোধ করা হলো।
রচনাকাল – 23/02/2015
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী