সংকলন – লাবিব মাহফুজ চিশতী
বর্তমান সময়ের ব্যাপক আলোচিত বিষয় নবী (সা) কিসের তৈরী? 22/06/1703 তারিখে নবী (সা) এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী জন্ম নেওয়া শয়তানের শিং আব্দুল ওহাব নজদীর ধর্ম পরিপন্থি জঘন্য বিকৃত মতবাদ ওহাবিবাদ প্রচারের আগ পর্যন্ত কেউ রাছুল (সা) কিসের তৈরি এ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে নাই। কোরান এবং হাদিস অনুযায়ী সকল সাহাবি, তাবেয়ী, ইমামগণ, মুহাদ্দেসগণ সহ অলি-আউলিয়া সকলেই তথা উম্মতে মুহাম্মদীর আকিদাই ছিল মুহাম্মদ (সা) স্বয়ং নিজেই নূর।
ওহাব নজদির অনুসারী সকল দলগুলো ইসলামের এবং নবীর শত্রু বিধায় তাদের উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন উপায়ে নবীজিকে ছোট করা, নবীজির প্রতি উম্মতের আস্থা, ভালোবাসা কমিয়ে উম্মতকে মেরুদন্ডহীন জাতিতে পরিণত করা। সেই লক্ষে তারা প্রচার করছে বিভিন্ন জঘন্য মতবাদ। যেমন, নবী (সা) আমাদের মতো সাধারন মানুষ, তিনি মাটির তৈরি, তিনি নূর নন, তিনি মারা গেছেন/হায়াতুন্নবী নন, তার সম্মানে মিলাদ কিয়াম করা যাবেনা, তিনি গায়েব জানেননা, তিনি শাফায়াত/সুপারিস করতে পারবেন না ইত্যাদি।
আমাদের সচেতন থাকতে হবে ঈমান বিধ্বংসী দলগুলো যেন আমাদের ঈমান নষ্ট করতে না পারে।
নূরনবী প্রসঙ্গে কুরআন এবং হাদিসের আলোকে দলীল-প্রমাণ একত্রিত করা হলো।
মহানবী (সা) নূরে মুজাসসাম। তিনি স্বয়ং নূর। রাসুলুল্লাহ (সা) কে আমাদের মতো সাধারন মানুষ বা মাটির মানুষ যারা বলে এটা তাদের কুফুরী আকিদারই বহিঃপ্রকাশ। কারণ, তারা কুরআনের আয়াত এবং হাদিস অস্বীকার করে ফলে তারা পথভ্রষ্ট এবং নবী (সা) এর শানে বিয়াদবি করে যা কুফরি। নবী (সা) এর ওপর মিথ্যারোপ করা বা অপবাদ দেয়া বা বেয়াদবীর পরিণাম অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। (বাকারা ১০৪, সোয়াদ ৭৭, আহযাব ৫৭, হুজরাত ২,৩, তৌবাহ ৬১,৬৬) ইত্যাদি।
“ইয়া আহলাল কিতাবি ক্বাদ জায়াকুম রছুলূনা ইউবায়্যানুলাকুম কাছিরাম মাম্মা কুনতুম তুখফুনা মিনাল কিতাবি ওয়া ইয়্যাফু আন কাছিরি ক্বাদ জায়াকুম মানাল্লাহ নুরুন ওয়া কিতাবুম মুবিন।” (সুরা মায়িদা ১৫)
অর্থাৎ- হে আহলে কিতাবগণ, তোমাদের কাছে আমার রাসুল আগমণ করেছেন। কিতাবের যেসব বিষয় তোমরা গোপন করতে তিনি তার মধ্যে থেকে অনেক বিষয় প্রকাশ করেন এবং অনেক বিষয় মার্জনা করেন। তোমাদের কাছে এসেছে একটি নূর ও একটি সমুজ্জল গ্রন্থ।
এ আয়াতে স্পষ্ট ভাবে রাছুলুল্লাহ (সা) কে বলা হয়েছে তিনি নূর।
তাফসিরকারকদের মতামত তুলে ধরা হলো।
১. নিশ্চয় তোমাদের কাছে নূর অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা) এসেছেন। (তাফসিরে ইবনে আব্বাস – ৭২পৃ)
২. তোমাদের কাছে নূর অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা) এসেছেন। (তাফসিরে ইবনে জারির – ৬খন্ড ৮৬পৃ)
৩. আল্লাহর নিকট হতে তোমাদের কাছে নূর অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা) এসেছে। (তাফসিরে খাজিন – ১খন্ড ৪১৭পৃ)
৪. আর নূর হলেন হযরত মুহাম্মদ (সা)। কেননা, তাঁর নূরে হেদায়েত লাভ করা যায় এবং তাঁকে উজ্জল প্রদীপ বলা হয়েছে। (তাফসিরে মাদারেক – ১খন্ড ৪১৭পৃ)
৫. নিশ্চয়ই নূর বলতে মুহাম্মদ (সা) এবং কিতাব বলতে কুরআন মাজিদ কে বুঝানো হয়েছে। (তাফসিরে কবির – ৩খন্ড ৩৯৫পৃ)
৬. নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট থেকে তোমাদের নিকট মহান নূর এসেছে। (তাফসিরে জালালাইন শরীফ – ৯৭পৃ)
৭. নিশ্চয় তোমাদের নিকট এসেছে মহান নূর। আর এ নূর হলো মুহাম্মদ (সা)। (তাফসিরে রুহুল মায়ানি – ৬খন্ড ৯৭পৃ)
৮. নূর দ্বারা রাসুল (সা) এবং কিতাবুম মুবিন দ্বারা কোরআন কে বুঝানো হয়েছে। (তাফসিরে রুহুল বায়ান – ২য় খন্ড ৩৬৯পৃ)
৯. নূর অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা)। (তাফসিরে মাআলিমুত তানিল – ২য় খন্ড ২৩পৃ)
১০. তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন ৫৪পৃ।
১১. তাফসিরে আবি সউদ ২য় খন্ড ২৫১পৃ।
১২. তাফসিরে রুহুল বায়ান ২ খন্ড ৩৬৯পৃ।
১৩. তাফসিরে রুহুল মায়ানি ১খন্ড ৩৬০পৃ, ৬খন্ড ৯৭পৃ, ১০খন্ড ১৬৬পৃ, ১৪খন্ড ৪৮পৃ।
১৪. তাফসিরে ইবনে জারির ৬খন্ড ৮৬পৃ।
১৫. তাফসিরে কবির ১১খন্ড ১৬৩পৃ, ১৬খন্ড ৩৪পৃ।
১৬. তাফসিরে কুরতুবি ৬খন্ড ১১৮পৃ।
১৭. তাফসিরে বায়জাভি ১খন্ড ৬৪পৃ।
১৮. তাফসিরে মাজহারি ৩খন্ড ৬৮পৃ।
১৯. তাফসিরে কবীর ৬খন্ড ৪৬২পৃ।
২০. ছফওয়াতুত তাফাসির ২খন্ড ১৪০পৃ।
২১. তাফসিরে দুররে মনসুর ২খন্ড ১৮৭পৃ, ৩খন্ড ২০১পৃ।
২২. তাফসিরে নুরুল কোরআন ৬খন্ড ১৬১পৃ।
২৩. তাফসিরে নঈমী ৬খন্ড ২৯৫পৃ। তাফসিরে মাওয়ারদী ৪খন্ড ৪১১পৃ।
২৪. তাফসিরে ইবনে আব্বাস ৪খন্ড ২৪পৃ।
২৫. তাফসিরে আহকামুল কোরআন লিল ইবনুল আরাবি ৩খন্ড ১৫৪৬পৃ।
নূরনবী সংক্রান্ত হাদিস সমুহ –
১. হযরত জাবের থেকে বর্ণিত : সমস্ত বস্তু সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তোমার নবীর নূরকে তার আপন নূর হতে সৃষ্টি করেছেন। (মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া ১ম খন্ড ৭১পৃ, শরহে যুরকানি ১খন্ড ৮৯পৃ)
২. হযরত কাব আহবার থেকে বর্ণিত : আল্লাহপাক আপন নূরকে হুকুম করলেন তুমি মুহাম্মদ হয়ে যাও। তোমা হতেই সৃষ্টির শুরু এবং তোমা হতেই রিসালাতের শেষ। (সিরাতে হালভিয়া ১ম খন্ড ৫০পৃ)
৩. মা আয়েশার কাপর সেলাইয়ের সুচ হারিয়ে যাওয়ায় তা খোঁজার সময় রাসুল সেখানে হাজির হলে তিনি বলেন নবী (সা) এর চেহারা মুবারকের নূরের জ্যোতিতে আমার অন্ধকার ঘর আলোময় হয়ে গেল এবং আমি হারানো সুচ খুঁজে পেলাম। (নেয়ামাতুল কোবরা আলাল আনাম ৪১পৃ)
৪. ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত : আদম (আ) কে সৃষ্টি করে আল্লাহ তাকে তার সন্তানদের মধ্যেকার মর্যাদার তারতম্য দেখালে তিনি শেষপ্রান্তে একটি সবার মধ্যে প্রজ্জলিত উজ্জল নূর দেখে বললেন ইনি কে? আল্লাহপাক বললেন, ইনি আহমদ, তিনি প্রথম, তিনি শেষ, তিনি হবেন আমার দরবারে প্রথম সুপারিশকারী। (আল খাসাইসুল কুবরা ১খন্ড ৩৯পৃ)
৫. আবুল ফজল কাযি আয়াজ বলেন : আল্লাহ তার নাম রেখেছেন নূর ও সিরাজুম মুনির। (শিফা শরিফ ২খন্ড ২৪২পৃ)
৬. আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত : রাছুলুল্লাহ (সা) বলেন, আমিই ছিলাম সেই নূরানি তারকা যার জন্ম জিবরাইলের জন্মের অনেক আগে। (সিরাতে হালভিয়া ৪৯পৃ,তাফসিরে রুহুল বায়ান ৫৪৩পৃ)
৭. সূর্য ও চন্দ্রের আলোকে নবি (সা) এর শরীরে ছায়া পড়ত না। কারণ, তিনি ছিলেন আপাদমস্তক নূর। (যুরকানি শরীফ ৪খন্ড ২২০পৃ)
মাওলানা জৌনপুরি বলেন, নবী করীম (সা) যখন গর্ভে ছিলেন তখন তার মা কোনো ব্যাথা অনুভব করেন নি। এটাও তার নূর হওয়ার প্রমান।
নবী (সা) বলেন, আমার জন্মের প্রাক্কালে আম্মাজান দেখেছিলেন, একটি নূর তার গর্ভ হতে বের হয়ে সিরিয়ার প্রাসাদসমুহ পর্যন্ত আলোকিত করেছে। আমি আমার মায়ের দেখা সেই নূর। (মিশকাত শরীফ)।
আরো দেখতে পারেন মিশকাত শরীফ ৫১৩পৃ, ২৪ এর ১০নং হাশিয়া, ৫১১ এর ৬নং হাশিয়া, তিরমিযি শরীফ ২খন্ড ৩৭পৃ, মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া ৪৫পৃ, শরহে সুন্নাহ ১০খন্ড ২০৭পৃ, মিরকাত ১খন্ড ১৪৬,১৬৬,১৯৪পৃ, তিরমিজি শরীফ ২খন্ড ৩৭পৃ, মাজুময়ায়ে ফাতাওয়া ২খন্ড, নশরুত্তীব ৫পৃ, এমদাদুদ ছুলুক, শুকরে নিয়ামত, গাওহারে সিরাজি, মকতুবাতে ইমামে রব্বানি মুজাদ্দিদে আলফেসানি ৩ জিলদ ১০০মকতুব ।
রাসুল (সা) ধ্যান করার কারণে হেরা পর্বত হয়ে গেলো জাবালে নূর অর্থাৎ নূরের পাহাড়।
তাঁর দুই কন্যাকে বিবাহ করার কারনে উসমান (রা) হয়ে গেলেন জিন্নুরাইন বা দুই নূরের অধিকারী।
তিনি মদিনায় শুয়ে আছেন বলে মদিনা হয়ে গেলো মদিনা মুনাওয়ারা বা নূরের শহর।
নূর : মায়েদা ১৫, আহযাব ৩২
গায়েব জানতেন : তাকভির ২৩, আল ইমরান ১৭৯, বুখারি জানাযা অধ্যায় হাদিস নং ১২৬৩
হাজির নাজির : আহযাব ৫৬,৪৫
হায়াতুন্নবী : আহযাব ৪৫,নাহল ৮৯
নবীজী (সা) আমাদের মতো না; বুখারি শরীফ সিয়াম অধ্যায় হাদিস নং ১৮০০, ১৮৩৭, ১৮৩৮, ১৮৩৯, ১৮৪০, ১৮৪৩
কে আছ আমার মতো? বুখারি শরীফ হাদিস নং সিয়াম অধ্যায় ১৮৪১
নবী (সা) নূরের তৈরিঃ
মিশকাত শরীফ ২৪পৃ উবাই ইবনে জাবের (রা), মুসনাদ ৭১পৃ আবু আমামাহ (রা), ইবনে হিব্বান ৫১০পৃ, যুরাতা ইবনে আউফ (রা)(আহমদ ও তিরমিজি)
নবী (সা) এর কিছু একক মর্যাদা –
১. ব্যাপক অর্থবোধক সংক্ষিপ্ত কালাম করার ক্ষমতা।
২. আমার উম্মতের জন্য সমস্ত জমিন সেজদার জায়গা।
৩. ৪০টি আয়াতে আল্লাহ ও রাসুল (সা) এর নাম একসাথে লিখিত।
৪. সবার জন্য শাফায়াত করার ক্ষমতা (বোখারি)।
৫. আরশ, কুরছি, লওহ, কলম, আসমান, জমিন, চন্দ্র, সুর্য সব কিছু আমার নূরে তৈরি (হযরত জাবের রা.)।
৬. আরশে আযিমে আল্লাহর নামের সাথে নবীর নাম অঙ্কিত (কানযুল উম্মাল)।
৭. নির্মল পাক পবিত্র অবস্থায় জন্ম (ইবনে ছায়াদ)।
৮. শিশুকালে চাঁদের সাথে কথা বলা ও খেলা করা (আব্বাস রা.)।
৯. খররৌদ্রতাপে মেঘমালার ছায়া দিত (আবু নোয়াইম)।
১০. কোরআন মাজিদে পরিপুর্ণ বিবরণ (আল কোরআন)।
১১. সামনে পিছনে দিনে রাতে সমান দেখা (বুখারি,বায়হাকি)।
১২. নিদ্রাবস্থায়ও সবকিছু দেখতে পেতেন (বোখারি)।
১৩. ঘাম মোবারক মেশকের চাইতেও বেশি সুগন্ধময় (আবু নোয়াইম)।
১৪. দেহ মোবারকের ছায়া ছিল না। কারণ, তিনি ছিলেন আপাদমস্তক নূর। (তাফসিরে কবির, আশ শেফা)।
১৫. স্বচক্ষে স্বশরীরে আল্লাহর দিদার লাভ।
১৬. নবীগণের মধ্যে একমাত্র তিনিই উম্মি (সৃষ্টির মূল) উপাধি প্রাপ্ত। (রুহুল বায়ান)।
১৭. সমস্ত ধনভান্ডার ও ইলমে গায়েবের চাবিকাঠি তাঁর (বুখারি, মুসলিম, মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া)।
১৮. ন্যূনতম ৬৫ হাজার মোজেজার অধিকারি (পয়গামে মোহাম্মদী)।
১৯. সমস্ত নবীদের সম্মিলিত উম্মতের চেয়ে হুযুর (সা) এর উম্মত বেশি (সুরা কাওসার)।
২০. সমস্ত নবীদের নাম ধরে সম্বোধন, হুযুর (সা) কে উপাধি ধরে সম্বোধন (আল কোরআন)।
২১. সব আল্লাহর প্রেমিক,আল্লাহ নবী (সা) এর প্রেমিক।
২২. ভুল ত্রুটি হতে সম্পুর্ন মুক্ত।
২৩. শয়তান হুযুর (সা) এর সুরত ধারন করতে পারে না।
২৪. চাঁদ দ্বিখন্ডিত করণ।
২৫. সুর্যকে পুনরায় উদিত করণ (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া)।
২৬. আল্লাহর মাহমুদ ও আহাদ নাম হতে মুহাম্মদ ও আহমদ (রুহুল বায়ান)।
২৭. আল্লাহর নাম রাসুলকে প্রদান (মাদারেজুন নবুয়্যত)।
২৮. মাকামে মাহমুদ (শাফায়াতে কোবরা)র অধিকারী।
২৯. রওযা মোবারক আরশ হতে উত্তম।
৩০. নামাযে নবী (সা) কে সম্বোধন করে সালাম দেওয়া।
জালালউদ্দিন সুয়ুতি খাসায়েছে কোবরা গ্রন্থে ১২০০ টি বৈশিষ্ট লিপিবদ্ধ করেছেন।
নবী (সা) মুমিন কিংবা মুসলিম নন, তিনি নিজেই ঈমান, তিনি নিজেই ইসলাম। নবী (সা) স্বয়ং দ্বীন। তাঁকে সমস্তকিছুর উর্দ্ধে ভালোবাসার নামই ধর্ম। তাঁকে সর্বান্তকরণে ধারণ করার নামই ইবাদত।
মহান প্রভু সকলকে ধর্মহীন দজ্জাল চক্রের হাত হতে রক্ষা করুন। নবীপ্রেমে উজ্জীবিত করুন আমাদের সকলকে। আমীন।
সংকলক – লাবিব মাহফুজ চিশতী