পত্রিকা – যাদের কোনো ধর্ম নেই – ৪র্থ সংখ্যা ২য় পর্ব

হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী

আরো জানা দরকার সেই পরম সত্য কিন্তু নহে হিন্দু, নহে মুসলমান, নহে খ্রিষ্টান বা বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ, শুদ্র, কায়স্থ। আসলে মানুষই চিরসত্য, নিত্য, চিরন্তন-শাশ্বত। যারা ধর্ম বলতে বেশ-ভূষণ আর ধর্মের নামে নিছক কিছু আনুষ্ঠানিকতার ঘটা বুঝে এবং বুঝায় তাদেরই প্রতিহিংসার এবং গোড়ামীর আক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে যুগে যুগে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় দিকগুলো এবং জ্ঞানীগণ। এবং ঐ সমস্ত অন্ধ-বধির-গোঁড়াদের কারণে বহু মহাপুরুষগণকেও অত্যাচার-নির্যাতন, দেশ ত্যাগ এবং হত্যার শিকার হতে হয়েছে। আর মানুষকে এভাবে পথভ্রষ্ট করে চলেছে। একদল আলেম-মোল্লা আছে তারা ইসলামকে হেফাজত করার অজুহাতে তাদের কুৎসিত ব্যক্তিস্বার্থ আদায়ের ধান্ধায় চিৎকার করে ফিরছে। এই ধর্মান্ধদের হুঁশ থাকা উচিত যে, যাকে বলে ইসলাম তথা মানবাত্মার সার্বজনীন মানবধর্ম তা আঠার হাজার মাখলুকাতের বাহিরে স্থিত আছে। সেই মানবাত্মার মানবধর্ম বা দ্বীন-এ-মুহাম্মদীকে পৃথিবীর কোনো মানুষ কোনো দিনই বিকৃত করতে পারবে না। কারণ, তা আল্লাহর হেফাজতে আছে। আল্লাহর হেফাজতে আছে কোরানও, তাও কোনো মানুষ কোনো দিন বিকৃত করতে পারবে না। আর আলেম-মোল্লারা সেই চিরন্তন-শাশ্বত, কদিম কোরানকে চেনেও না এবং পাঠ করতেও জানে না। ইসলামের পঞ্চ বিধান ছালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ্জ্ এবং কালেমা হলো ইসলামে পৌঁছার পথ। এ পথে ধাবিত হয়ে আঠার হাজার মাখলুকাতের গুণ-খাছিয়ত বা তিন জমাত বা তিন দায়রা অতিক্রম করে ইনছানিয়াতে অধিষ্ঠিত হলেই ইসলাম লাভ করা যায়। এ পথে উরূজের জন্যই পঞ্চ বিধান জারি আছে।

ইসলাম হলো পারলৌকিক বিষয় এবং মুক্ত-স্বাধীন চৈতন্যের জগত। ইসলামের মধ্যে যারা পরিপূর্ণভাবে অধিষ্ঠিত হয়েছে তারাই মুমিন বা অলি-আউলিয়া। মুমিন বা অলি-আউলিয়া আর আলেম-মোল্লাদের বিরোধ চিরকাল। মুমিনগণ মুক্ত, স্বাধীন, সর্বদা চৈতন্যে কায়েম আছেন। যারা ইসলামকে ধারণ করেছে তারাই ইহলোকের মানুষের মাঝে ঐক্যতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইসলামের সামাজিক বিধান তৈরী করে মানুষকে সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করতে এবং পরস্পর প্রেম-মহব্বত, ঐক্যতায় এসে বাস করার বিধান তৈরী করে থাকে, যাতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শান্তি-শৃঙ্খলা, পরস্পর ভ্রাতৃত্ব-সৌহার্দ্যভাব বজায় থাকে। এ পথ হতে যে সত্ত্বাটি মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখে তা হলো খান্নাছ। সেজন্যই বলা যায় তথাকথিত আলেম-মোল্লাদের মধ্যে ইসলাম ধর্মকে লাভ করার কোনো শিক্ষাই নেই, অথচ ইসলাম হেফাজত করার জন্য চিৎকার করছে। আসলে এ সমস্ত ধর্মান্ধরা ইসলাম কি জিনিস তা বুঝেইনি। শুধু খোলসটি নিয়ে দৌঁড়ঝাপ দিচ্ছে আর চিৎকার করছে। এক বন্ধু বললো, ভাই গতকাল তোমার ভাবি ডেলিভারীতে মারা গেছে। অপর বন্ধুটি বললো, ভাই এ রোগটি আসলেই খুব ভয়ংকর। কারণ, গত বৎসর ডেলিভারী রোগে আমার বাবাও মারা গেছেন।

মোল্লা-মৌলবীদের ইসলামের ব্যাখ্যাটি এ রকমই। কোথায় সার্বজনীন দ্বীন-এ-মুহাম্মদী বা ইসলাম আর কোথায় মোল্লাতন্ত্রের ইসলাম। ইসলাম কি জিনিস তা না বুঝেই হেফাজত করতে লেজ তুলে দৌড়াচ্ছে, আর অন্যান্য ধর্মান্ধ গোঁড়ারাও পিছনে পিছনে লেজ তুলে দৌড়াচ্ছে। মানে জমিনে থেকে আসমানের চাঁদ হেফাজত করতে চাচ্ছে। আসলে এরা যা হেফাজত করতে চাচ্ছে তা হচ্ছে তাদের দাঁড়ী, টুপি, জুব্বা, পাগড়ী আর ব্যক্তিস্বার্থের কিছু মতবাদ ইত্যাদির। মোল্লাতন্ত্রের ইসলাম- যার প্রবর্তক হলো ইয়াজিদ মোল্লা। এ ধরনের ইসলামের হেফাজতের দাবী ইয়াজিদ মোল্লাও করেছিলো এবং অধিকাংশ মানুষকে সে বুঝাতেও পেরেছিলো যে সে-ই সত্যপথে বা ইসলামের পথে আছে, হযরত ইমাম হুসাইন আলায়হিস সালামই ভুল পথে আছে। হযরত ইমাম হুসাইন আলায়হিস সালামকে রাষ্ট্রদ্রোহী সাব্যস্ত করে ৩৫০জন ইয়াজিদের আলেম-মোল্লারা তাঁকে হত্যা করা জায়েজ বলে ফতোয়া দিয়েছিলো। সে ফতোয়া শীমার তার পাগড়ীর নিচে নিয়েই ইমাম হুসাইন আলায়হিস সালামের শীর কেটেছিলো। এখনো সাধারণ মানুষকে ইয়াজিদপন্থী আলেম-মোল্লারা বুঝাতে পেরেছে যে, তারাই সঠিক পথে আছে। যদিও এ ইসলামের সূত্রপাত নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের ওফাতের কিছুদিন পূর্ব হতেই শুরু হয়েছিলো একদল সাহাবী নামধারীদের দ্বারা। আর কারাবালার পর হতে ইয়াজিদ মোল্লা আর তার অনুসারীদের দ্বারা প্রচলন ঘটে তা পূর্ণরূপে। কোরানের রূপক-প্রতীক বা কাঠামো তাশাবাহার অনুসারী ইয়াজিদ এবং ইয়াজিদপন্থী আলেম-মোল্লাদের ষড়যন্ত্রে বাইয়্যেনাত-মুহকামাত জ্ঞানগর্ভ আয়াত জানা ইমাম হুসাইন আলায়হিস সালামকে শহীদ করে ইয়াজিদের মতবাদকে ইসলাম বলে প্রচার করার জন্য মসজিদে মসজিদে তাবলিগ শুরু করে।

ফলে ইয়াজিদের মতবাদ, তথা –
(১)
অন্ধ অনুমানে আল্লাহকে এক জেনে অদৃশ্য আল্লাহর ইবাদতের প্রবর্তন করা- যা ছিলো আজাজিলের মতবাদ,
(২) তাশাবাহা বা রূপক-কাঠামো বা আক্ষরিক অর্থ দিয়ে কোরানের তাফসির করা এবং কোরান পাঠ করা এবং কাগজের কোরানই হলো আল্লাহর তরফের নাজিল কোরান- এ ধারণা প্রচার করা,
(৩) বায়াত না হয়ে তথা পীর-মুর্শিদের নিকট না গিয়ে কোরান-হাদিসের আক্ষরিক মতে চললেই আল্লাহ খুশী হবেন, জান্নাতে যেতে পারবে,
(৪) শুধু আনুষ্ঠানিক নামাজ-রোজা-হজ্জ, যাকাত, মৌখিক কালেমা পাঠই ধর্মকর্ম,
(৫) আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে ঈমান না এনে বাপ-দাদার গতানুগতিক ধারায় ধর্ম বিশ্বাসের প্রবর্তন করা।
(৬) অলি-আউলিয়াকে এবং তাদের ক্রিয়া-কর্মকে অস্বীকার করা ইত্যাদি প্রথা প্রবর্তন করা হলো।

সেই হতে জানা বা অজানা সত্ত্বেও ইয়াজিদের মত তারা ইসলাম বলে চালিয়ে আসছে এবং তার শিক্ষার জন্য শত-সহ¯্র্র মাদ্রাসা তৈরী করে চলছে। অথচ ইসলাম আছে আল্লাহর হেফাজতে, পৃথিবীর কোনো মানুষই তা বিকৃত করতে পারবে না। যা পারবে তা হলো ইসলামের সামাজিক বিধান। আর ইসলামের সামাজিক বিধান বিকৃত করছে অন্ধ-বধির আলেম-মোল্লারাই। এর মূল কারণ, এরা সত্যকে লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছে, বিধায় শত মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে তাদের মধ্যে। যা যুগে যুগে যুগোন্নতির তাগিদে মানুষের সামাজিক কল্যানে নবুয়তের ভাষায় নবী-রাছুল এবং বেলায়েতের ভাষায় অলি-আউলিয়াগণ প্রয়োগ করে থাকেন। এ বিধান যখন অন্ধ-বধির এবং বোবা আলেম-মোল্লাদের দ্বারা সংঘটিত হয় তখনই শত মতভেদ, ফেরকাবাজি, ফতোয়াবাজি, ধর্মের নামে মারামারি, মানুষ হত্যা ইত্যাদি চলতে থকে। এরা নারীদেরকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখার জন্য এবং হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য কতো রকমের যে মিথ্যা বানোয়াট হাদিসের এবং কিস্সার আমদানি করেছে তার ইয়াত্তা নেই।

উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি মিথ্যা হাদিসের মূল অংশ তুলে ধরা হলো –

“আমি যদি কাউকে অপর কাউকে সেজদা করার আদেশ করতাম, তাহলে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম যেনো তার স্বামীকে সেজদা করে”।

“তোমরা বিভিন্ন ব্যাপারে মেয়েদের সাথে পরামর্শ করবে কিন্তু সে অনুযায়ী কাজ করবে না”।

“নারী জাতি সমস্ত অমঙ্গলের জন্মদাতা। যতো অমঙ্গল সবই নারী জাতিরই সৃষ্টি”।

“মেয়েদেরকে না ভালোবাসার মধ্যে রাখো আর না তাদেরকে লেখাপড়া শেখাও”।

“উত্তম সংসারই হলো কবর বা মৃত্যু এবং জীবন্ত কন্যা সন্তান দাফন একটি সম্মানের ব্যাপার”।

“হযরত ফাতেমা আলায়হিমাস সালাম বলেন, “মেয়েরা যেনো পুরুষদের না দেখে এবং পুরুষরাও যেনো তাদের না দেখে। তারপর নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, পরস্পর পরস্পরের সন্তান”।

“কোনোক্রমেই নারীরা পুরুষদের প্রতি তাকাতে পারবে না এবং পুরুষও নারীর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারবে না” ইত্যাদি।

আরো অনেক মিথ্যা হাদিস এবং হাদিসের বিকৃত ব্যাখ্যা তথা আক্ষরিক অর্থ করে নারীদেরকে অত্যন্ত কঠোরতার মধ্যে ধর্মান্ধরা আবদ্ধ করে ব্যক্তি-স্বাধীনতা হরণ করে মানসিক নির্যাতন করে চলেছে ধর্মের দোহাই দিয়ে। অথচ কোরান মতে নারী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরের অংশ। কোরানে উম্মতে মুহাম্মদীকে একটি মধ্যপন্থী জাতি হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং মধ্যম পন্থা অবলম্বনই হলো উত্তম- এ কথাও ঘোষণা করেছে। মাওলা আলী ইবনে আবি তালিব আলায়হিস সালামের কালাম হলো ঃ “তোমরা সবসময় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে”। কোরান-হাদিসের ভুল এবং আক্ষরিক ব্যাখ্যা করে নারীদেরকে নিছক একটি ভোগ্যপণ্য হিসেবে সাব্যস্ত করে রেখেছে এবং পর্দার ব্যাপারে অত্যাধিক বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে- যা নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের সময়ও করা হয়নি। পর্দার নির্দেশ কখন এবং কি কারণে হয়েছে, তা নবী পরিবারের জন্য এবং উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে কতোটুকু প্রভেদ এবং অভেদ আছে তা নির্ণয় না করেই ঢালাওভাবে অত্যাধিক বাড়াবাড়ি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে আরব বিশ্বের একজন খ্যাতিমান লেখক আবদুল হালীম আবু শুক্কাহ রচিত “তাহীরুল মায়া ফী আসরির রিসালাহ্” গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করে নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের যুগে নারীদের অবস্থা-স্বাধীনতা এবং বর্তমান যুগের নারীদের অবস্থা-স্বাধীনতার মধ্যে কতোটুকু প্রভেদ রয়েছে তা অসংখ্য দলিলাদির দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে। আমাদের একদল আলেম-মোল্লাদের অত্যাধিক বাড়াবাড়িতে এবং পশ্চাৎমুখী ফতোয়ার কারণে নারীদের অবস্থা করুন পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে- যা নবীজির সময় মোটেই ছিলো না। অথচ ইসলাম মধ্যপথ অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছে। নারীর যে একজন মানুষ এবং তাঁর স্বাধীন সত্ত্বা আছে, সে কথা এবং ভাবনার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে ফতোয়ার কাঁদা ছোড়াছুড়ি করে। এমনকি তাদেরকে শয়তান এবং শয়তানের সমতুল্য বলতে এবং বুঝাতেও কসুর করেনি। নারীদের দেখলে অজু ভেঙ্গে যায়, মসজিদ নাপাক হয়ে যায় ইত্যাদি ফতোয়া এবং মতবাদও শ্রুতিগোচর হচ্ছে। তাদের ব্যক্তি-স্বাধীনতা হরণ করে তাদের মতের বা পছন্দের বিপরীতে বিবাহেও অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য করছে।

আপন খবর