প্রবন্ধ – ধর্মান্ধতা! ধর্মের নামে!

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

ধর্ম আত্মমুক্তির বিধান। ত্যাগের অনুশীলন তথা রিপুনিচয়ের বা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধের কঠোর সংযম সাধনার মধ্য দিয়ে পরিশুদ্ধতার পথে ধাবমান একটি জিবন’ই হলো প্রকৃত মুসলমানের জিবন। আত্মিক পথ পরিক্রমণে মহান প্রভুর গুণাবলী মানবীয় অস্তিত্বে ফুটিয়ে তোলাই আমাদের পরম মোক্ষ। প্রভুগুণে গুণান্বিত হলেই আমরা স্থিত হবো নিত্যলোকে, শান্তির ধামে, ইসলামে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আত্মিক পরিশুদ্ধতার এ পথ তথা ইসলাম এর অবস্থা আজ বরই করুণ। অধর্মের ভয়াল থাবায় আজ মূমুর্ষ ইসলাম। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা! অধার্মিকদের সংখ্যাধিক্য আর বিস্তর অপকর্মের দরুণ ইসলাম আজ মৃতপ্রায়। গুটিকয়ের সত্যানুসন্ধানীর সাথে নির্বাসিত! আজ অধার্মিকরা ধর্মীয় নেতৃত্বে আসীন! তাদের হাতে বানানো ধর্ম দ্বারা প্রতিনিয়ত কলঙ্কিত করছে ইসলামকে।

কোরান রূপক সাহিত্য হওয়ায় এবং খোদ কোরানেই রূপক প্রতীকের অনুসরন করতে নিষেধ করা সত্ত্বেও ধর্মীয় অতিপন্ডিত শ্রেণী এবং সংখ্যাগুরু নির্বোধ কথিত ধার্মিক সম্প্রদায় কোরানের রূপক-প্রতীক অনুসরণেই তৈরী করে নিচ্ছে ধর্মবিরোধী বিভিন্ন ক্রিয়াকর্ম। প্রতিনিয়ত কলঙ্কিত করছে ধর্মকে। যুগে যুগে ধর্ম এসব অধার্মিকদের হাতে কলঙ্কিত হয়েছে। এসব অধার্মিকরাই সর্বকালে সংখ্যায় অধিক এবং তারা বাস করেছে ধর্মীয় নিরাপত্তা সহকারে ধর্মের ছদ্মাবরণে।

বর্তমান সময়ের এরকম একটি অতিমারী বর্বর জঙ্গী সন্ত্রাসী সংগঠন হলো তালেবান, যারা ধর্মের ছদ্মাবরণে বাস করে প্রতিনিয়ত কলঙ্কিত করছে ধর্মকে। আফগানিস্তান কে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ইসলামী শাসনের নামে মনগড়া বর্বর অনৈসলামিক শাসন ব্যাবস্থা কায়েম করে বিশ্বব্যাপী সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে তালেবানরা। সীমা ছাড়িয়ে গেছে তালেবানদের অপকর্মের। এমন কোনো নিন্দিত কর্ম নেই যা তারা করছে না। জ্ঞানান্ধ, ধর্মান্ধ, উগ্র, বর্বর এই সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে আজ জিম্মি পুরো আফগানিস্তান। তারা মানুষ হত্যা থেকে শুরু করে সকল হত্যাযজ্ঞ ও অপকর্ম করে যাচ্ছে ধর্মীয় ছদ্মাবরণে। নৃশংসতা, বর্বরতা, গোঁড়ামী আর ধর্মীয় অপব্যাখ্যার অপর নাম তালেবান। দেওবন্দ পন্থী সালাফীবাদ বা উগ্র ধর্মচেতনার দ্বারা পরিচালিত এসব সন্ত্রাসীগুলো তাদের বিকৃত ও ভারসাম্যহীন ধর্মশিক্ষার প্রদর্শনী করছে আফগানিস্তানে। পরিতাপের বিষয়, অনেকেই আফগানিস্তানে তালেবান শাসন কে দেখছেন ইসলামী জাগরণ হিসেবে! সেই সব অতিবোদ্ধাদের জন্য একরাশ অনুশোচনা!

আনুমানিক দু লক্ষ সন্ত্রাসী যোদ্ধার সমন্বয়ে তৈরী তালেবান একটি আফগান উগ্র জঙ্গী সম্প্রদায় যারা বিভিন্ন অমানবিক কার্যকলাপের জন্য পরিচিত ও আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার জন্য লড়াই করছে দীর্ঘদিন থেকে। ইদানিং তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যেয়ে কথিত ইসলামী শাসনের নামে দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠা করছে এমন উদ্ভট, অমানবিক আর অনৈসলামিক শাসনতন্ত্র, যা সভ্য সমাজ কল্পনাও করতে পারেনা। তারা আগেও তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা সমূহে জারি করেছিল এমন সব নিন্দিত ও বর্বর শাসনব্যাবস্থা।

মানুষ হত্যায় তালেবানদের জুড়ি নেই। প্রগতিশীল আফগানদের নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে তারা। মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ এলাকা পুড়িয়ে দিয়েছে, হাজার হাজার আফগানদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে তালেবানরা। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, পদ্ধতিগত এবং ধারাবাহিক ভাবে আফগান নাগরিকদের গণহত্যা করেছে তালেবানরা। তাদের ক্ষমতায় থাকার কয়েক বছরে (১৯৯৬-২০০১) ১৫ বার গণহত্যার শিকার হয়েছে আফগানরা। নিষ্ঠুরতার কি নির্মম প্রদর্শণী! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষদের হত্যা করা হতো ছুরির দ্বারা গলা কেটে ও চামড়া কেটে!

নারীদের প্রতি অত্যাচারের মাত্রায় তালেবানরা শীর্ষে! তাদের বিকৃত ধর্মচিন্তার ফসল হিসেবে আফগান নারীদের ঘরবন্দী করা হয়েছে। হিংস্রভাবে শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে তারা অর্ধেক আফগান জনগোষ্ঠীকে রীতিমতো গৃহবন্দী করেছে। নারীদের ওপর নেমে এসেছে নির্মম অত্যাচার। রাস্তাঘাটে মার খেতে হয়েছে বহু নারীকে। আবার নিজেদের নোংরা যৌন চাহিদা মেটাতে এসব নারীদেরকে দলে দলে ধরে নিয়ে সৈন্যশিবিরে যৌনদাসী করা হয়েছে। নারী নির্যাতন ও শিশু বলাৎকার থেকে শুরু করে এমন কেনো যৌন নিপীড়নমূলক বীভৎসতা নেই, যা তালেবানরা করে নি।

মানব পাচারের মতো ঘৃণিত কর্মে তারা সিদ্ধহস্ত। সংখ্যালঘু জাতির নারীদেরকে যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে তারা। তাদের অর্থের বড় একটি যোগান আসে আফিম চাষ থেকে। তারা আফগান কৃষকদেরকে দিয়ে অস্ত্রের মুখে ভয় দেখিয়ে পপি ফুলের চাষ করায়। মাদক বিক্রি করে তারা যোগাড় করে অর্থ। এই পপি ফুলের বীজ থেকেই আসে আফিম ও হেরোইন।

অন্যান্য আফগান জাতিসমূহের প্রতি বৈষম্যে তালেবান দের জুড়ি মেলা ভার! তাদের কথিত শরিয়া (?) আইনের কঠোরতা ও অমানবিকতার ফলে আফগানিস্তান থেকে দ্রুত তাদের সংখ্যা হ্রাস পায়। অন্যান্য ধর্মালম্বীদের ধর্মাচরণে নিষেধাজ্ঞা আনা হয় এবং তাদের প্রতি বৈষম্য ও অত্যাচার প্রবলভাবে চলে।

জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি সকল ধর্মান্ধদের মতোই তালেবান দেরও প্রচুর চুলকানি। জ্ঞানের আলো তাদের অজ্ঞতার রাজ্যে বরাবরই হুমকি স্বরুপ। তাদের মূর্খতা ঢেকে রাখার জন্য তারা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি সহিংস। তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানের প্রায় অর্ধেক স্কুল ধ্বংস করা হয়। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হয় নৃশংস হামলা। নারী শিক্ষকদের প্রতি চলানো হয় নির্মম অত্যাচার। তাদের স্কুলে আসা বন্ধ করা হয়। তাদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে সহ¯্রাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নিহত হয়েছে অগনিত শিক্ষার্থী। ১৯৯৮ সালে তারা পুলি খুমরি পাবলিক লাইব্রেরী ধ্বংস করে। অসভ্য জংলীপনার এর চাইতে বড় উদাহরণ আর হয় কি? যুগ যুগ ধরে ধর্মান্ধরা লাইব্রেরী ধ্বংস করেছে। আগুনে বই পুড়িয়েছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে চাওয়াই অজ্ঞদের বড় বাসনা। কারণ, পেঁচা কখনো সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না। লাইব্রেরীটিতে ৫৫ হাজারেরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বই ছিল। জংলী জাতি শিল্পের মর্যাদা কি বুঝবে? তারা আফাগান জাতীয় জাদুঘরের প্রায় তিন হাজার শিল্পকর্ম ধ্বংস করে। তাদের কথিত শাসনতন্ত্রে গান বাজনা নিষেধ, খেলাধুলা নিষেধ, ছবি আঁকা, টেলিভিশন সহ সকল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিষেধ। সকল বিনোদন নিষেধ। বাচ্চাদের ঘুড়ি ওড়াতে দেখলেও তারা মারধোর করতো! বর্বরতা আর কুশিক্ষা কোন পর্যায়ে পৌঁছলে মানুষ এমন অমানবিক আর অরুচিকর হতে পারে?

বর্বরতা আর মূর্খতাকে যদি কেউ ধর্ম বলে তাহলে তা হাস্যকর বৈ অন্য কিছু নয়। আফসোস তাদের জন্য যারা আবার এসব গাঁজাখুরি কথায় বিশ্বাস করে। এসবকেই ধর্ম মনে করে। আর এসব যারা করে তাদেরকে ধার্মিক মনে করে। ধিক সালাফিবাদ ও দেওবন্দিবাদকে, যারা অজ্ঞতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিয়েছে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে।

মানুষ হত্যা করা, নারীদের কে যৌনদাসী করা, বলাৎকার করা, মাদক ব্যাবসা করা, স্কুল কলেজ ধ্বংস করা, গণহত্যা, বই পুড়িয়ে দেয়া সহ এসকল ক্রিয়াকলাপ কে যারা ইসলাম বলবে তারা ইসলামের শত্রু ব্যতিত অন্য কেউ নয়। সন্ত্রাস কখনো ইসলাম হতে পারে না। মানুষ হত্যা করে যারা মুসলিম হতে চায় সে বন্ধ উন্মাদ। ইসলাম শান্তি-মুক্তির ধর্ম। মানবিকতার ধর্ম। আত্মিক পরিশুদ্ধতার ধর্ম। এখানে কোনো অজ্ঞতা, মূর্খতা, অমানবিকতার কোনো স্থান নেই। মহান প্রভু সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।

রচনাকাল – 10/11/2017
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর