মোতালিব চিশতী
আমরা শুধু বাহ্যিক চাকচিক্য বা পোশাকের মর্যাদা দিতে জানি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজিত অন্ধত্ব আর আমাদের অজ্ঞতা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এমন হীনমন্য করে রেখেছে। যার সুযোগ গ্রহণ করেছে এক শ্রেণীর নামধারী জালিম সম্প্রদায়, যারা আলেমের বেশ-ভূষা গ্রহণ করে লিপ্ত হয়েছে অধর্ম তথা অপকর্মে। তাদের বাহারী পোষাক আর খুবসুরত চেহারা দেখে সমাজের সাধারণ মানুষ তাদেরকেই বসিয়েছে ধর্মগুরুর আসনে। তারাও সে সুযোগে ইচ্ছেমতো কলুষিত করে চলেছে ধর্মকে। মানুষের ঈমানকে হরণ করে যুগের পর যুগ অন্ধত্বের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে তারা। তারা নিজেদের অপ-স্বার্থ হাসিল করার জন্য ধর্মের মর্মবাণীকে আড়াল করে শুধুমাত্র রূপক বা মোতাশাবেহাতের মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। মানবতা কে উপেক্ষা করে শুধু বাহ্যিক পোষাক-আশাক আর রূপক প্রতীকের এ রাজত্বে আজ নির্বাসিত হয়েছে সত্য বিধান। উপেক্ষিত হয়েছে প্রকৃত ধর্ম।
ধর্মব্যাবসায়ী এসকল ধান্দাবাজদের খপ্পর হতে জনসাধারণ বের হতে পারছেনা বলেই এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী অন্ধ, বধির, পথভ্রষ্ট আর গোমরাহ রয়ে গেছে। তারা এখন দেখে না, শুনে না, বুঝেও না। তারা দেখে শুধু বাহ্যিক আবরণ বা পোষাক। অথচ মানুষ হওয়ার জন্য পোষাক নয়, দরকার একটি সুন্দর, পবিত্র, নির্মল আর মনুষ্যত্ববোধে পূর্ণ একটি হৃদয়। যে হৃদয়ে থাকবে মানুষের প্রতি দরদ আর ভালোবাসা। যে হৃদয়ে সদা বেজে চলবে মানবতার জয়গান। অন্ধদের কাতারে দাড়িয়ে থাকা জীবগুলোর জ্ঞানচক্ষু বন্ধ থাকে ব্যক্তিস্বার্থের পর্দায়। সত্য তাদের নয়নে রেখাপাত করেনা। তারাও সত্যটাকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করে না। ধর্মীয় দৃষ্টিতে তারাই দাজ্জাল। তাদের দ্বারাই পথভ্রষ্ট হচ্ছে বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী। পোশাকের তো কোন দোষ নেই, দোষ হলো তার, যে এই পোশাক পরে পোশাকের মর্যাদা রক্ষা করেনি, বরং এই পোশাকের অন্তরালে থেকে অমানবিক যতসব কর্মকান্ড করে বেড়াচ্ছে। আর সমাজের সহজ সরল মানুষগুলোর সরলতাকে পুঁজি করে নিজেদের আখের গুছাচ্ছে। তারাই হলো মানুষরূপী শয়তান, তাদেরকেই হাদিসে দাজ্জাল বলা হয়েছে, আর এদেরকেই কালামে পাকের ভাষায় বলা হয়েছে প্রকাশ্য শত্রু।
আজ সময় এসেছে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার। অজ্ঞানতার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে, সত্য-সুন্দর আর বাস্তবধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করা আজ সময়ের দাবি। মনে রাখা দরকার, সত্য-সুন্দর আর সঠিক জ্ঞানের আলোয় পরিবার, সমাজ ও দেশ আলোকিত করতে না পারলে আমাদের আগামী প্রজন্ম অন্ধকার থেকে আরো অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।
এমন পোষাকী দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই আজ জগত জুড়ে যত বিশৃঙ্খলা। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আজ গ্রাস করেছে সমগ্র জগতকে। ধর্ম শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা করে একদল আলেম নামধারী জাহেল শ্রেণী বিভ্রান্ত করে বেড়াচ্ছে সাধারণ মানুষদেরকে। ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ বিভক্ত হয়েছে শত সহ¯্র দল-মতে। করে বেড়াছে হানাহানি, রক্তপাত। শান্তির ধর্মকে নিক্ষিপ্ত করেছে অশান্তির আস্তাকুড়ে।
উপরে মানুষসুরত, ভেতরে পশু স্বভাব ধারণকারী এসব মুনাফিকদের জন্যই মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী লিখেছেন, ‘আমি বহু মানুষ দেখেছি যাদের গায়ে পোশাক নাই, আবার বহু পোশাক দেখেছি, যার ভিতরে মানুষ নাই।’ সাধন দাস বৈরাগী লিখেছেন, ‘থাকলে হাত, পা, নাসা, চক্ষু, কর্ণ, মানুষ তারে বলে না, মানুষ হওয়াই মানুষের সাধনা।’
দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে আমাদেরকে গাইতে হবে মানবতার জয়গান। যার মধ্যে মানবতা নেই, তার কোন ধর্মই নেই। যে পথে গমন করেছেন অসংখ্য নবী-রাসূল, গাউস-কুতুব, পীর-মাশায়েখ, ওলী- আউলিয়াগণ। যাদের সংস্পর্শে এসে অসংখ্য পথহারা মানুষ পেয়েছেন পথের দিশা। যারা মিথ্যার বেড়াজাল চ্ছিন্ন করে মানবজাতিকে দিয়েছেন সত্যের সন্ধান। মানবজাতিকে এই সত্যের সন্ধান দিতে গিয়ে অসংখ্য নবী-রাসুল, ওলী-আউলিয়া, পীর ফকিরগণ লেবাছধারী জালেমদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন।
যারা তাদের আত্মত্যাগ, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং মুনাফেকদের দ্বারা বিভিন্ন ষড়যন্ত্র আর নির্যাতনের শিকার হয়েও অন্ধকারাচ্ছন্ন মানবমন্ডলীর মাঝে সত্যের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন, মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন অকাতরে, পথহারা মানুষকে দিচ্ছেন সিরাতুল মুস্তাকিম এর ঠিকানা, সেই মহান সাধকদের মধ্যে অন্যতম একজন সাধক হলেন আমার মহান মুর্শিদ কেবলা হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী (কুঃ ছেঃ আঃ)।
যার রচিত কালজয়ী গ্রন্থসমূহতে তিনি বাস্তব মুক্তির পথনির্দেশনা দান করেছেন পতিত মানবদেরকে।