পত্রিকা – বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ০২

লেখক – আজহার ফরহাদ

কথা বলতে পারাতেই ভাষার জন্ম নয়। ভাষা গড়ে ওঠে মনের ভাব প্রকাশে। বর্ণ ও শব্দ দিয়ে বাক্য গঠন ভাষায় পরিচয় না, ভাষা তাকেই বলে যা জীবনভাষ্য হয়ে উঠবার কলকব্জা। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে ভাষাভিত্তিক আত্মপরিচয়ের দৃঢ় অবস্থান থেকে। এমন এক জাতি বিশ্বে বিরল। ভাষাতো সকলেরই রয়েছে। বহু ভাষাই আগ্রাসনের করালগর্ভে বিলীন হয়েছে। পৃথিবীর অনেক বড় বড় ভাষার মানুষজন নানানভাবে সমঝোতা করেছেন সে আগ্রাসনের সঙ্গে। কিন্তু বাংলাদেশে তা হয় নি কেন? আমরা ভাষাগত বিশেষত্বের ভেতর দিয়ে অস্তিত্বরক্ষার জন্য জীবনদান করেছি, এ কি শুধুই ভাষার প্রতি প্রেম বা আচ্ছন্নতা? তা নয়।

বাংলা ভাষা যে গড়েপিঠে তৈরি হয়েছে সাধকের হাতে। আদি হতে আদিতম রূপটিকে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় তার সমৃদ্ধি। ছন্দময়, কাব্যময়, গভীর অনুসন্ধানের গূঢ় হতে গূঢ় দার্শনিকতার চর্চা হয়েছে এই ভাষায়। অথচ তা গানের সুরেই। এ ভাষায় প্রাচীনতম ইতিহাস পাওয়া যাবে গানের ভেতর। এখানে ভাষা-গান-সুর একসূত্রে গাথা। তাই আমাদের লিপিবদ্ধ ইতিহাস দুর্বল কিন্তু মৌখিক ইতিহাস সমৃদ্ধ।

মুখে মুখে বয়ে চলা গীতিময় এ ইতিহাস সুগভীর ও আত্মানুসন্ধানী। আমাদের নাথসাহিত্য, চর্যাগান, বৈষ্ণবগীতি এ ধারাবাহিকতার ফসল। কিন্তু যে ভাষার ভেতর এত ঐতিহ্যমন্ডিত দর্শনপাঠ ও জীবনজিজ্ঞাসা রয়েছে গানের মাধ্যমে, তা কেন শিক্ষিত বাঙালি জীবনকে নাড়া দিতে পারে নি? কারণ, এ শিক্ষালাভ আরোপিত ও অনুকৃতিময়। বাঙালির আত্মপরিচয়ের উদাসীনতার এ এক ভিন্ন নজীর। অধিকাংশের কাছে বাউল-ফকিরগণ আত্মভোলা উদাসীন শিল্পীমাত্র। জীবন বহির্ভূত প্রান্তিক উপজীবী। মধ্যবিত্তের বৃহৎ শিক্ষিত সমাজ এই ঐতিহ্য সম্পর্কে মূলত উদাসীন, তার আত্মসংকটের অন্যতম কারণও এটি।

কিন্তু বাউল-ফকির সমাজ প্রান্তিক হয়েও কতখানি অগ্রসর আমরা তা জানি না। তার সাধনা নিছক ব্যক্তিগত সাধনা নয়। তারা মানবজীবন ও মানুষকেই প্রধান অবলম্বন মনে করেন। শাস্ত্র ও ধর্মীয় জটিল ও কুটিলতর আচারসর্বস্বতা হতে মুক্ত মানবতাবাদী দার্শনিক, প্রেমিক, ভক্ত ও দাস। এরা মানুষের দাসত্ব করেন, যে মানুষের ভেতর মনের মানুষের দেখা মেলে। সে মনের মানুষ কোনো বিমূর্ত চরিত্র নয়, ক্ষুদ্র ‘আমি’র ভেতর সুপ্ত থাকা ‘পরম-আমি’; যে ‘আমি’ আমার ভেতর সীমাবদ্ধ নই, সর্ব-আমি’র ঐকতান। সে ঐকতানে একটা বিশ্বময় বিরাট মনুষ্যত্বের অভিন্ন পরিচয় পাওয়া যায়। এ পরিচয়ই বাউলের আরাধ্য, তার ধর্ম। এ কারণে বাউল পরম্পরাকে ‘মানবধর্ম’ আখ্যা দেওয়া হয়।

বাউল আর ফকির একটু আলাদা। বাউল বলে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মাচার, সম্প্রদায় আছে বলে আমি মনে করি না; এ হলো নানান ধর্ম ও মতের মানুষের উচ্চতর আত্মানুভবের মিলনস্থল। এরা পরমতসহিষ্ণু ও লোকায়ত। যেমন করে একজন বৈষ্ণব বাউল হন, একজন শাক্ত বা শৈব বাউল হতে পারেন; এমনকি খুঁজে দেখলে খ্রিস্টানদের ভেতরেও বাউল পাওয়া যাবে, তেমনি একজন ফকির লালন শাহও বাউল। মধ্যযুগের সন্তমত, সুফিবাদ কিংবা বৌদ্ধদের ভেতর বাউল ছিল। বাউলিয়ানা নির্দিষ্ট কোনো আচরণ নয়, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক মরমীবোধের বহুবর্ণিল চিহ্নপরিচয় যা মূলত দমসাধনা ও মানুষগুরুর আরাধনানির্ভর বিষয়-বিরাগী সঙ্গীতমুখী পরম্পরা।

রবীন্দ্রনাথ এই বাউলচেতনাকে ‘মানুষের সহজধর্ম’ বলে মত দিয়েছেন। এই চেতনাই বাংলার সবচেয়ে জোরালো ও জনভিত্তিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক শক্তিমত্তার ভিত্তিমূল। ইসলামের সুফি-ফকিরী পরম্পরার মানবতাবাদী দর্শনের যে প্রভাব বাংলাদেশে সুদীর্ঘকাল হতে বিদ্যমান তার ভেতর দিয়ে সে একই বাউলিয়ানাই প্রকাশ পায়। চরম সাম্প্রদায়িক ও আচারসর্বস্ব ধর্মান্ধতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাউল-ফকিররাই প্রশ্ন করতে ও উত্তর দিতে সক্ষম। তাদের এই সওয়াল-জওয়াব কখনো শাস্ত্রানুগত হলেও যুক্তিপ্রবণ।

বাউল-ফকির পরম্পরার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো, তা প্রাতিষ্ঠানিকতা দোষে দুষ্ট নয়। বাংলার প্রতিষ্ঠানবিরোধী একমাত্র পূর্ণাঙ্গ শক্তিই এটি। সুদীর্ঘকাল ধরে বাউল-ফকিররা আধুনিক সভ্যতা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নানান চাপান-উতোর প্রচেষ্টা হতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছেন। সমসাময়িক জীবন ও জগত সম্পর্কে অংশগ্রহণমুলক ভাবনা রেখেও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয় কেবল, প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্রচিন্তা ও সামাজিকতার সাথেও বিনয়ের সাথে একই দূরত্ব রক্ষা করে থাকেন। কিছুকাল আগে বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজে এমন একটি ভাবনা প্রচলিত ছিল যে বাউলরা বিশেষ করে ফকির লালনের গান সাধারণ মানুষের বোধগম্যের বাইরে; একেবারেই সাধকের সাধনসঙ্গীত।

কিন্তু এ ধারণা নিতান্ত অজ্ঞানমুলক। লোকসমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক ও আত্মিক ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞানতাই এ ধারণার মূলে। এমন চিন্তা আমাদের লোকজীবনের অত্যন্ত সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আঘাত করে এবং গ্রামীন জনপদ ও প্রান্তিক মানুষদের অবমূল্যায়িত করে। আজকের এই পুঁজিবাদী ও কর্পোরেট আগ্রাসনের ভেতর দিয়ে খুব কমসংখ্যক শিক্ষিত মানুষ রয়েছেন যারা বাউল-ফকিরদের তথাকথিত সাধনসঙ্গীতকে সর্বব্যাপকতা দিয়ে দেখতে পান। এর অধিকাংশই নিম্নআয় ও শ্রেণীর। যাদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা সুখকর নয়।

গ্রন্থগত বিদ্যাকে চরম পরাকাষ্ঠা হিসেবে দেখছি বলে লোকজীবনের সুদীর্ঘ সঙ্গীতময় চিন্তা ও জ্ঞানপরম্পরাকে উপেক্ষা করবার ধৃষ্টতা। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা ও গবেষণার পর দেখতে পাওয়া যায় একাডেমিক জ্ঞানচর্চার মাপকাঠিতে দর্জির এক কাপড় বহুবার কাটবার গল্পের মতো গৌণ হয়ে পড়ে বাউল চেতনা। আমরা নিজেরা বিভ্রান্ত ও স্ববিরোধী হয়ে উঠি; না বর্তমান, না অতীত, না ভবিষ্যৎ, না ধর্ম, না আধুনিকতা, না উত্তরাধুনিক ভাবনাপ্রকল্পনা বিশ্বব্যাপী চালু হওয়া কর্পোরেট ধ্যান-বাণিজ্য, না আরব জাতীয়তাবাদী উগ্র ওহাবী মতবাদ, কোনটিই ভালো করে বোঝাপড়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু আমরা সাংস্কৃতিক চেতনাকে ধারণ করতে চাই, যে সংস্কৃতির সাথে আমাদের বিস্তর দূরত্ব।

সংস্কৃতির ঘনীভূত হওয়া নিছক কিছু উপাদানকে মন্ডমিঠাইয়ের মতো উপভোগ করতে উদগ্রীব হই কিন্তু দুধেল গাভীটি কোথায় আছে? কি খাচ্ছে? তার প্রতি উদাসীন। রূপকথার ডিমপাড়া হাঁসের মতোই বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিচার করছি। যেন চিরকালই আমাদের সোনার ডিম উপহার দেবে। কিন্তু সে হাঁস যে রক্তমাংসের এবং লোকজীবনের খোয়াড়েই বসত করছে, সে জ্ঞান আমাদের আজও হলো না।

প্রথাগত কিংবা প্রথাবিরুদ্ধ, যে কোনো অর্জনের একটা ধর্ম থাকে। ধর্মহীন কোনো অস্তিত্ব নেই। ধর্ম হলো স্বভাব, ধারণ-আচরণ। তা যখন বৈচিত্র্যকে দমন করতে চায়, সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে। বাউল-ফকিররা ধার্মিক কিন্তু সাম্প্রদায়িক নন। তারা বৈচিত্র্যকে শ্রদ্ধা করেন, সময়কে ধারণ করেন এবং সামনের দিকে এগিয়ে চলেন। এই সামনের দিকে এগিয়ে চলা মানে সমসাময়িক হয়ে ওঠা, বর্তমান নিয়ে বাঁচা; অতীত বা ভবিষ্যতের কল্পনা-জল্পনা দিয়ে নয়। বর্তমানের মুখোমুখি হওয়া, প্রশ্ন করা এবং প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। তার কাছে দুনিয়াই সারবস্ত্র; এখানেই স্বর্গ-নরক, এখানেই বিচার ও মুক্তি। গৃহ ও সংসারত্যাগী বাউল হওয়া হয়তো সহজ কিন্তু গৃহে ও সংসারে যার বাউলমন সদাজাগ্রত তাঁর পথ বড় কঠিন। পালিয়ে বেড়াবার সুযোগ কই? যুদ্ধই তাঁর নির্বাণের শহীদানা পরিণতি।

আজকের বিশ্বব্যাপী সংকটের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ইসলাম ও ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের মহড়া ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। বোদ্ধাগণ যতই একে সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক অপশক্তির খেলাচ্ছল হিসেবে দেখুক না কেন, এতো সত্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চরম পরাকাষ্ঠার যুগে বিপুল পরিমাণ মানুষ ধার্মিকতার নামে ধর্মান্ধ এক অপতৎপরতায় যুক্ত হচ্ছে। একদিকে অপরিণত ও আরোপিত ইয়োরোপীয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ অন্যদিকে অচেতন ও অন্ধকারাচ্ছন্ন ধর্মচিন্তার নতুন বিন্যাস আমাদেরকে শঙ্কিত করছে। না বুঝতে পারছি ধর্মনিরপেক্ষতা, না ধারণ করতে পারছি প্রকৃত ধর্মবোধ। অথচ আমাদের নিজেদেরই রয়েছে বোঝাপড়ার লোকায়ত ও লোকোত্তর দেশনা।

ধর্মে ও প্রগতিশীলতায় আমরা এমনই প্রশ্নহীন বোবায় পরিণত হয়েছি যে কথা বলার অন্তর্গত শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। লোকসমাজের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাউল-ফকিরগণ এখনও পর্যন্ত জিইয়ে রেখেছেন সে পরম্পরা, যেখানে আত্মিক ও পারমার্থিক অনুপ্রেরণার মাধ্যমে জীবন ও জগতকে প্রেম ও আত্মজিজ্ঞাসাময় সম্ভাবনার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া। দার্শনিকভাবে সমাজ ও জীবনকে মূল্যায়ন করা। জীবনের গভীরতা ও অর্থবহতা অনুসন্ধানে বাংলার প্রকৃত বরপূত্র এরাই। বাঙালির সাংস্কৃতিক ধর্মকে চিনতে হলে এর ভেতর দিয়ে যেতে হবেই।

সমাজসচেতনতার রাজনৈতিক ভূমিকায় বাউল-ফকিরদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ। মূঢ় সামাজিকতা ও ধর্মান্ধতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফকির লালন যে যুগান্তকারী বৈপ্ল­বিক মানবতাবাদী আত্মদর্শনের প্রচার করেছেন তাকে কেবলমাত্র গুহ্য সাধনতন্ত্রের একজন সাধক হিসেবে বিবেচনা করা নির্বুদ্ধিতা। লালন ফকির সেই শিরদাঁড়া খাড়া করবার চেষ্টা করেছেন যা নুয়ে পড়েছিল সমাজ-সভ্যতা-মতাদর্শ-প্রাতিষ্ঠানিকতার ছায়াতলে। এর আগে ফকির মজনু শাহ তৈরি করেছিলেন বাংলার মানুষের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক আত্মসংগ্রামের ভিত। তার আগে কোনো বিদ্রোহ বা সংগ্রাম ভারতবর্ষকে এতটা আন্দোলিত করতে পারে নি। ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪০ বছরের এই ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহই ভারতবর্ষকে বিশেষ করে বাংলার সাধারণ মানুষের মনে আত্মজাগরণের রাজনৈতিক সূচনা ঘটাতে পেরেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা সংগ্রাম, তার সাথে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সেই পুরনো আত্মসচেতন বিদ্রোহচেতনা হতেই আসা। বাংলাদেশের মানুষের লড়াই করবার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য তার সংগ্রামী জীবনকে এতটাই মহত্ত্বপূর্ণ করে তুলেছে যে একটি জাতি একসাথে একটি যোগে যুক্ত হতে বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়েনি। সুযোগ্য নেতৃত্ব ও অনুপ্রেরণায় তাকে একতাবদ্ধ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়নি। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ফকিররা ছিলেন মাদারিয়া সিলসিলার সুফিসাধক।

সমাজকাঠামোর অগ্রহণযোগ্য পরিবর্তন ও বিভেদ-রাজনীতির মূলোৎপাটনে যে সমাজসচেতনার ভিত তারা গড়ে দিয়েছিলেন তা অদ্যাবধি বিদ্যমান। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের লোকজীবনে সুফি-ফকির প্রভাবিত মূল্যবোধের সংস্কৃতি বিরাজমান। আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও আত্মনির্ভরতার হাতেখড়ি এখানেই। এ পরম্পরাটি তারও আগে নাথযোগীদের হাতে তৈরি করা। গোরক্ষনাথ ও মীননাথের চারণভূমি এই বাংলা। নাথযোগী ও সুফি ফকিরীমত এতটাই নিকটতর হয়ে এসেছিল যে পরবর্তীতে গড়ে ওঠা দিগম্বর ফকির বা লেংটা ফকিররা বিশেষ করে সোলায়মান শাহ লেংটার সাধনজীবনকে এরই ধারাবাহিকতা বলে ধারণা করা যায়।

বাংলার আত্মশক্তি অনুধাবণে বাউলচেতনা কতভাবে নানান সাধনা ও জ্ঞানমার্গকে আত্মস্থ করে টিকে আছে আজ পর্যন্ত তা বড় বিস্ময়কর! কিন্তু এই বিস্ময় আমাদের কাছে রহস্যময় এক ধোঁয়াশা অধ্যায় বলে মনে হয়। আমাদের সাংস্কৃতিক শক্তিমত্তার প্রতিকৃতি অঙ্কনে আর কোন কোন চেহারাকে আঁকতে পারি যা এতটা বিবর্তনের ভেতর দিয়েও বর্তমান! পাঞ্জাবে বুল্লে শাহ প্রগতিশীলদের কাছে মহান বিপ্লবী, বাংলায় ফকির লালন বাউলমাত্র। সংখ্যালঘুর প্রগতিচেতনা দিয়ে সংখ্যাগুরুর প্রতিনিধিত্ব হলো অংশীদারিত্বহীন সমাজচিন্তা। যার খেসারত আমরা দিনের পর দিন দিয়ে যাচ্ছি। মত ও পথের সংঘাত যতখানি বড় হয়েছে ততখানি অনুসন্ধানী হতে পারেনি মানুষের মন।

কাল পরিবর্তন ছাড়া মহাকালকে ধরতে পারে না। প্রতিটি কালই একেকটি পরিবর্তনের মাধ্যমে মহাকালে যুক্ত হয়। এই যেমন একটা ছোট পুকুর কতকাল আর টিকে থাকে; কিন্তু বড় বিলের মাঝখানে যেসব ছোট ছোট জলাশয় থাকে তা কখনও মরে না। ওতে সংযোগ থাকে নদীর। কালকে অবশ্যই কোন বৃহত্তর অর্থবহতার সাথে যুক্ত হতে হয় নইলে তা মরে যায়, মহাকালের মহানদী-সঙ্গমে যুক্ত হতে পারে না।

আত্মময়তার সবচাইতে বড় সমস্যাটি হলো তা অত্যন্ত গভীর হতে বাস্তবতাকে ঝাপসা দেখে। কিন্তু যে আত্মসচেতন, সে সমাজ-কাঠামোর সাথে একটি যৌক্তিক সম্পর্ক রাখতে জানে, বুঝতে পারে ঠিক কোন দিক দিয়ে গল্পটা শেষ হবে আর শুরু হবে নতুন কোনো গল্পের। বাউল-ফকিররা কালপর্বের পরিবর্তন সম্পর্কে খুব সতর্ক। এই পরিবর্তন কীভাবে ঘটবে, কে ঘটাবে এসব বিষয়ও তারা আলোচনা করেন। ওদের সমাজবিশ্লেষণের রয়েছে নিজস্ব পদ্ধতি, যা তাঁরা অত্যন্ত সহজভাবে করতে জানেন। পৃথিবীজুড়ে যে অস্থিরতা ও সংকট তার পরিবর্তন কিভাবে ঘটবে সে ফর্মূলা তাঁরা জানেন না কিন্তু এটুকু বুঝতে পারেন যে কাল ঠিক কোনসময়ে তার দিক বদলায়, মহা পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়।

আমরা এমনই এক পরিবর্তনের মহাকাল-দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি যেখান থেকে সরে যাবার উপায় নেই। কিন্তু খুব কম মানুষই এই পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন।
এখন প্রস্তুতি নেবার সময়। যার পক্ষে যতখানি সম্ভব ঠিক ততখানি নিয়ে রাখা। কিন্তু কথা হলো এটা তো বুঝতে হবে আসলে কি ঘটতে যাচ্ছে। কেউ যদি নাই বুঝতে পারে তবে কি করে ঠিক করবে, সে আসলে কি চাইছে? ধরা যাক, কেউ একজন বললো, আমি মিষ্টি খুব পছন্দ করি; এই কথায় এটা ঠিক পরিষ্কার হয় না যে তা চিনি, না মধু, নাকি মিষ্টান্ন? কেউ মিষ্টি খুব পছন্দ করতে পারেন আবার পায়েসটা নাও করতে পারেন, কারো হয়তো খেজুরের রস ভাল লাগে না আবার তালের রস পেলে কেউ কিছুতেই না খেয়ে থাকতে পারেন না। এটা একটা বিন্দু, যেখান থেকে নানান দিকে তিনি রেখা টানতে পারেন। এই বিন্দুরেখাটি হলো একেকটি মত, যা ওই মূলবিন্দু হতে সৃষ্ট। তাই লালনশাহী ফকিররা যা ভাবছেন, নাথসাধুরা যা ভাবেন, বৈষ্ণবসাধকরা যা ভাবেন, কপ্টিক খ্রিস্টান সাধু কিংবা সুফি ফকিররা যেমন করে ভেবে থাকেন তার ভেতর ওই রেখার পার্থক্যটি থাকবেই কিন্তু বিন্দুটি এক।

এই বিন্দু সম্পর্কে যদি আমরা জানতে চাই; এটি কি আসলেই সমস্ত রেখাগুলিকে উৎসমূলে ধরে টান দিতে পারবে?

কেন নয়? এটাইতো কাল নিয়ে মহাকালের খেলা। এর কেন্দ্রে যা ঘটে, সেখানে এমন একজন এসে দাঁড়ান যখন তার আপনা হতেই সকল গ্রন্থি খুলে যায়। এরকম ঠিক সবসময় হয় না। যখনই কোনো মহামানবের আগমন ঘটেছে যিনি কালপর্বকে যুক্ত করেছেন মহাপরিবর্তনের সাপেক্ষে তিনি হয়ে ওঠেন সেই কেন্দ্রবিন্দুর কর্তা। কালে কালে নানান জাতিতে ঘটেছে এমন ধারা। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটটি ভিন্ন। আজ পৃথিবী এতটাই ছোট হয়ে এসেছে, মানুষ এতকিছু জেনেছে, একে অপরের প্রতি অনধিকার চর্চা এতটাই বেড়েছে যে এখনকার পরিবর্তনটি আর কেবল নির্দিষ্ট জাতির ভেতর সীমাবদ্ধ রইবে না, এটি হয়ে উঠবে সমগ্র পৃথিবীরই পরিবর্তন।

আমরা কি এই পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে? দুয়ারটি খুললো বলে…

আপন খবর