লেখক – ফরহাদ রহমান দিনার
ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে মনুষ্য জাতি আজ ভুলে গেছে ঐশি পুরুষদের দেখানো সেই সাম্যের পথ, শান্তির পথ, প্রেমের পথ, মহাভাবের পথ। ফলে, সমগ্র পৃথিবীতেই আজ বেড়ে চলছে বিভেদ-বৈষম্য, ধর্মীয়-কলহ, সাম্প্রদায়িক-দ্বন্দ্বসংঘাত; দুর্বিষহ হয়ে উঠছে জনজীবন ও বিশ্ব জগত । কিন্তু কোনো প্রেরিত পুরুষই তো এটা প্রত্যাশা করেন নি যে- তাদের ধর্মগুলো পৃথিবীকে দুর্বিষহ করে তুলবে, তাদের মতাদর্শগুলো সাম্প্রদায়িক বিবাধের কারণ হয়ে মানবতা কে বিনষ্ট করবে, তাদের ধর্মগ্রন্থগুলো ‘এক মানবজাতিকে’ ভেঙে খানখান করে দিবে, তাদের অনুসারীরা ‘ধর্মের নামে’ মানুষে মানুষে বৈষম্য ও বিবাদ সৃ্ষ্টি করে এ ধরিত্রীকে দুর্গন্ধময় করে তুলবে এবং ধর্ম প্রতিষ্ঠার নামে হত্যা-যজ্ঞ, জঙ্গীপনা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে কালে কালে ইতিহাসের পাতাকে কলঙ্কিত করবে !!
জগতে শান্তিবাদ ও প্রেমবাদ প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই এ ধূলার ধরণীতে মহাপুরুষগণের অবতরণ । কিন্তু মানুষ তাঁদের সাম্যবাদী ভাবধারাকে বুঝতে না পেরে ভিন্ন ভিন্ন দলে, বিভিন্ন গোত্রে, আলাদা আলাদা সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পৃথিবীর সৌন্দর্য ও ঐশি পরিকল্পনাকে একেবারে বিনষ্ট করে দিয়েছে !! শান্তি ও সাম্যই যদি সব ধর্মের মূল কথা হবে, তাহলে ধর্মকে আশ্রয় করে কেন চারিদিকে চলছে এতো অশান্তি, এতো অশ্রুপাত? ধর্মকে কেন্দ্র করে সমগ্র পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতগুলো মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া হয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এত বেশি পরিমাণ মানুষকে জীবন দিতে হয় নি ।
অথচ মানুষের কল্যাণের জন্যই নাকি এ ধর্মের সৃষ্টি; কিন্তু সে ধর্মই যদি মানুষের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে, সে ধর্মই যদি মানুষে মানুষে বিভেদ ও বৈষম্য তৈরি করে, সে ধর্মই যদি সাম্প্রদায়িক কলহের সৃষ্টি করে, সে ধর্মই যদি মানুষের পবিত্র বুকে লাত্থি মারার শিক্ষা দেয়, সে ধর্মই যদি যুদ্ধ ও রক্তপাতের কারণ হয়, সে ধর্মই যদি মানুষের চোখে বেদনার অশ্রু ঝরায়, সে ধর্মই যদি স্রষ্টার আইন প্রতিষ্ঠার নামে মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, তবে কি আমরা বলতে পারি না যে- সেই ধর্মপথ বিধাতা প্রদত্ত কোনো ধর্মপথ নয়? বরং বিকৃত হয়ে যাওয়া জীর্ণ মতবাদের এক মৌলবাদী ভাবধারাকেই সমাজে ‘ধর্ম’ বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে মাত্র !! কেননা, যে ভাবদর্শন ‘মানুষে’ ‘মানুষে’ বিভেদ ও বৈষম্যের দেয়াল গড়ে তুলছে, মানুষে মানুষে প্রেম-মৈত্রীভাবকে ঘৃণায় পরিণত করছে; যে ধর্মদর্শন যুগে যুগে ইতিহাসের পাতাকে রক্তাক্ত করেছে এবং মানুষকে বাধ্য করেছে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে, লিপ্ত করেছে পারস্পরিক হত্যাকাণ্ডে; সেটা কখনোই বিধাতার দেয়া ধর্মদর্শন হতে পারে না । বরং সেটা মোল্লা, পাণ্ডা, যাযক, ভিক্ষু, পুরোহিতদের কবলে পড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়া এক অধর্ম !!
গবেষণা করে দেখা গেছে যে, ধর্মীয় মৌলবাদের বিষাক্ত ছোবলে প্রতিটি ধর্ম পথই আজ ক্ষতবিক্ষত, প্রতিটি ধর্ম মতই আজ বিভ্রান্তিতে জর্জরিত । ধর্মের দালানকোঠাগুলো আজ ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের দখলে । সমগ্র পৃথিবীতেই গোঁড়াবাদী ভাবদর্শনের ছাঁচে গড়ে উঠছে অগণীত উপাসনালয়, দেবালয়, মাদ্রাসা, গির্জা, মসজিদ, মন্দির, বৌদ্ধ মঠ ইত্যাদি । যার ফলশ্রুতিতে নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে গোঁড়াবাদী, জঙ্গীবাদী, মৌলবাদী, অনুষ্ঠানবাদী, নেশাগ্রস্থ উগ্রবাদী, সাম্প্রদায়বাদী ধর্মান্ধ রূপে । চলমান বিশ্ব পরিস্থিতি, মৌলবাদী তাণ্ডবলীলা, জঙ্গী নাশকতা ও ধর্মান্ধতা সেটারই স্বাক্ষ্য বহন করছে । কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখাগেছে যে, মূলত ধর্মপথগুলোর চেহারাকেই পরিকল্পিতভাবে পাল্টে দেয়া হয়েছে । ধর্মপ্রবর্তকগণের ভাবদর্শনের সাথে প্রচলিত ধর্মীয় ব্যবস্থাগুলোর খুব একটা মিল নেই বললেই চলে; বরং ধর্মগুলো বিকৃত হয়ে গেছে । ইসলাম ধর্মের কথাই ধরা যাক, মোহাম্মদী ধর্মদর্শনের সাথে প্রচলিত ইসলাম অনেক ক্ষেত্রেই সাংঘর্ষিক ।
মহানবি (স.) কখনোই সম্প্রদায়গত বিদ্ধেষ তৈরি করে দিয়ে যান নি, বরং তিনি ধর্মনিরপেক্ষ এক অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । নবি মোহাম্মদ কখনোই মানুষের লাশের উপর দিয়ে বেহেশত যাবার পথ রচনা করে যান নি; ধর্মের নামে, আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার নামে তিনি কখনোই মনুষ্য হত্যার শিক্ষা দিয়ে যান নি । কিন্তু প্রচলিত মুসলিমরা তাদের ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মের দোহায় দিয়ে ঠিকই অমানবিক এ নির্মম হত্যাযজ্ঞের এজিদী সুন্নতি-ধারা অব্যাহত রেখেছে, যা মোহাম্মদী ভাবদর্শনের সাথে একেবারেই সাংঘর্ষিক । ফলে, শান্তির ধর্ম ইসলাম আজ সমগ্র বিশ্বে হত্যা, খুন, মারামারি, রক্তক্ষয়ী ও জঙ্গীবাদী এক অধর্মে রূপান্তরিত হয়ে বিশ্ববাসীর কাছে জঘন্য ও ঘৃণিত ধর্মদর্শনে পরিণত হয়েছে; আর মহানবি (স.) বিশ্ববাসী ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বিদের কাছে একজন সন্ত্রাসী ধর্মগুরু হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ইসলামের পতাকাকে উজ্জিবীত ও সুমহান করে তুলেছে !! তবে, গবেষণায় এটাও বেড়িয়ে এসেছে যে, ধর্মের প্রকৃত সত্যকে বিনষ্ট করতে, ধর্মদর্শনের বিকৃত রূপকে সমাজে কৌশলে দাঁড় করিয়ে দিতে একদল ষড়যন্ত্রকারী সর্বকালেই গোপনে ও প্রকাশ্যে শয়তানি করে এসেছে ।
সর্বযুগেই একটি মোনাফেক চক্র ছিল, যারা প্রতিটি প্রেরিত পুরুষেরই বিরোধীতা করে এসেছে, সত্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে, ধর্মের গুটকাটা ইঁদুরে মত বিভিন্ন চক্রান্তে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় লিপ্ত থেকেছে । সত্য বলতে গেলে- মহানবির ক্ষেত্রেই সেই চক্রান্ত ও বিরোধিতার মাত্রা ছিল অত্যধিক । ইসলাম ধর্মের মধ্যেই সেই আত্মদ্রোহী মোনাফেকদের সংখ্যা ছিল অন্যান্য ধর্মের তুলনায় অনেক বেশি । একটু খোলামেলা ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় যে, নবি-পরিবার বিদ্বেষী কতগুলো কুলাঙ্গারের হাতেই লালিত হয়েছে আজকের ইসলাম । মূলত আজকের সত্যবিবর্জিত এই অনুষ্ঠান নির্ভর টুপি-দাঁড়ি পাগড়ি-পাঞ্জাবি ও মুখস্থ বুলি আওড়ানো মার্কা প্রচলিত ইসলাম তাদের হাত ধরেই এসেছে, যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে কারবালার ময়দানে নবি-বংশের বিরুদ্ধেই রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল । কারবালায় ইসলামের সাময়িক কবর রচনার পর মূলত এজিদী সিলেবাসকেই মোহাম্মদী ইসলাম বলে সমাজে চালিয়ে এবং একপ্রকার চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল ।
নবি বংশের জাতশত্রু উমাইয়ারা ইসলামী ক্ষমতায় আরোহণ করার পর থেকেই মোহাম্মদী ভাবদর্শনের অনুসরণ করার নামে চলছে এজিদ-মুয়াবিয়ার সিলেবাস অনুসরণ । নিজেদের সুবিধা মত কোরান-হাদিসের চেহারাকে পাল্টে দেয়া হয়েছে । উমাইয়া-আব্বাসিয়দের নিজস্ব ছাপাখানায় তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য সহি হাদিস, যার প্রতিটি রচনাই ছিল মিথ্যা ও বানোয়াট । বেঈমানেরা তাতেই থেমে থাকে নি, বরং কোরানের আয়াত ও রদবদল করে নিয়েছে (সূত্র: ইমাম বাকের); প্রায় অর্ধসহস্র আয়াত কোরান থেকে গায়েব করে দিয়েছে (সূত্র: বাজারে প্রচলিত কোরান); প্রায় পাঁচ লাখ হাদিস সহ হস্ত লিখিত শত শত কোরান পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং ইমাম গাজ্জালীর লেখা ১১৯ খণ্ডের কোরানের মূল্যবান সেই তফসিরটিও পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা সহ আরও অসংখ্য নেক্কারজনক কাজের দায়িত্ব তারা নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে ।
তাই বর্তমানে ইসলামের নামে চলছে মৌলবাদী, সন্ত্রাসবাদী, উগ্রবাদী, অনুষ্ঠানবাদী, ভোগবাদী, জঙ্গীবাদী, চাঁদাবাজি, মাইকবাজি, বলাৎকারবাজি, স্বেচ্ছাচারী, রাজকীয় ধর্ম পালন; আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার নামে চলছে মানুষ হত্যার পথ অনুসরণ । তবে মনুষ্য হত্যার মধ্য দিয়ে ধর্ম প্রতিষ্ঠা (?) করার এ সুন্নতি-শিক্ষা ইসলামের কুখ্যাত খলিফা ও সম্রাট (কায়সারুল আরব) কুলাঙ্গার ইয়াজিদের সিলেবাসে দেড় হাজার বছর পূর্বেই পাঠ্য ছিল !!
বিধাতার গোপন রহস্য এই মানুষ (হাদিসে কুদসি); আর সেই মানুষের বুকে লাথি মেরে যারা আল্লাহ-ভগবানের সন্তুষ্টি খুঁজে বেড়ায়, নিঃসন্দেহে তারা শাস্ত্রীয় এলকোহল পান করা বেঁহুশ । যারা মানুষের চেয়ে ধর্মকে বড় করে দেখে তারা মাতাল, তারা ভয়ংকর । এই মানুষই তো ধর্ম সৃষ্টি করেছেন, কোনো ধর্ম এই মানুষ সৃষ্টি করে নি (ঋষিমত)। সুতরাং, ধর্ম নয় বরং মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ । যদি মানুষই না বাঁচে তবে ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থ কিংবা ধর্মীয় দালানকোঠা দিয়ে কী হবে? কবি নজরুলের ধিক্কার: “তোরা ছেলের মুখে থুতু দিয়ে, মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া”? মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয় । কোরান, বেদ, বাইবেল, তাওরাত, ইঞ্জিল, গীতা, ত্রিপিটক, পৃথিবীর যত গ্রন্থ সবকিছু এই মানুষেরাই এনেছেন । কাবা, মন্দির, গির্জা, মসজিদ, প্যাগোডা, পৃথিবীর যত উপাসনালয় সব মানুষই সৃষ্টি করেছেন ।
কোনো গ্রন্থ বা কোনো উপাসনালয় এই মানুষকে সৃষ্টি করে নি, কিংবা মর্যাদায় মানুষকে ছাড়িয়ে যেতে পারে নি । বেঁহুশে চৈতন্যদানে কবি নজরুলের প্রেসক্রিপশন: “জগতের যত গ্রন্থ ভজনালয়, ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়”। তাহলে মোল্লা-পুরোহিত-পণ্ডিতদের মাতলামীর দরুণ সেই ধর্ম কিংবা ধর্মের দালান কোঠার জন্যে যদি একজন মানুষকেও জীবন দিতে হয় তবে এর চেয়ে দুঃখ ও লজ্জার আর কিছু হতে পারে না । মনুষ্য হত্যা মহা পাপ; আর সে হত্যা যদি হয় ধর্মের নামে, তবে এখানেই ধর্মের সবচেয়ে বড় পরাজয় ।
কোনো ধর্মের ধার্মিকেরাই ধর্মের সত্যকে, ধর্মপ্রবর্তকের শিক্ষাকে সঠিকরূপে বুঝে উঠতে পারে নি । তাই তারা জন্ম দিয়েছে দুর্বিষহ এই ধরিত্রীর । যে বুদ্ধ নাকি একটি তীরবিদ্ধ পাখিকে বুকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন, সেই বুদ্ধের অনুসারীরা আজ হাজার হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করছে; যে দুষ্ট বুড়ি মহানবির চলার পথে কাটা পুঁতে রাখা সত্ত্বেও সেই বুড়িকে মহানবি নিজেই সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন, আজ সেই মোহাম্মদেরই অনুসারীরা মানুষের লাশের উপর দিয়ে বেহেশতে যাবার পথে ভিড় জমাচ্ছে !! নবি মোহাম্মদের অনুসারী বলে কথিত ‘মোল্লারা’ ইসলামের সংজ্ঞা ঠিকঠাকমত বুঝে উঠতে পারে নি ।
মাতালেরা ঐশি-গ্রন্থের রুপক ভাষাকে ধরতে না পেরে ধর্মের নামে জন্ম দিয়েছে সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ, অহাবিবাদ । তারাই সর্বযুগে ধর্মের দোহায় দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে; তারাই ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার নামে মানবতাকে বিনষ্ট করেছে; রসুলের সাম্যবাদী ধর্ম ইসলামকে বিকৃত করেছে; কথিত বেহেশতে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিতে গিয়ে মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া হচ্ছে । বকধার্মিকেরা ইসলাম হেফাজতের নামে, ধর্ম রক্ষার নামে মারছে মানুষ, পুড়ছে ঘরবাড়ি, ভাঙছে দেবালয়, উপাসনালয়, অবলা হৃদয় !!