ইসলামের ইতিহাসে যাঁরা ঈশ্বরপ্রেমকে আত্মার পরম সাধনা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে এক উজ্জ্বলতম নাম তাপসী রাবেয়া আল-আদাবিয়া বা রাবেয়া বসরী (রহ.)। তিনি নারী হয়েও সুফিবাদের সেই মর্মস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যা সাধক-পুরুষদেরও ছাড়িয়ে যায় অনেক দিক দিয়ে। প্রেম, ত্যাগ, ইবাদত, নিঃস্বার্থভক্তি এবং অন্তরাত্মার সর্বোচ্চ আত্মনিবেদনই ছিল তাঁর সাধনার মূলস্তম্ভ। তাঁর জীবন একটি পবিত্র দীপ্তি, যেখানে আল্লাহর সাথে একান্ত সম্পর্কই ছিল একমাত্র সেতুবন্ধন। এই প্রবন্ধে আমরা তাপসী রাবেয়া বসরীর জীবনের সুফিপূর্ণ সাধনার ধারা, তাঁর ঐশ্বরিক প্রেমের ব্যাখ্যা এবং কিছু অমৃতবাণীর আলোকে তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন বিশ্লেষণ করব।
১. শৈশব, দাসত্ব ও মুক্তির আখ্যান
রাবেয়া বসরী জন্মগ্রহণ করেন ইরাকের বসরা নগরীতে, আনুমানিক ৭১৫ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর পরিবার ছিল গরীব, তবে ধার্মিক। পিতার স্বপ্নে একদিন নবী করিম (সা.) এসে বলেছিলেন, “তোমার এই কন্যা ভবিষ্যতে ওলিয়াদের রাণী হবে।” অল্প বয়সেই তাঁর পিতা-মাতা ইন্তেকাল করেন এবং তিনি দাসত্বে বিক্রি হন। তবে দাসত্বও তাঁর আত্মিক উজ্জ্বলতাকে নিভিয়ে রাখতে পারেনি। রাতভর নামাজ, সিজদা ও আল্লাহর স্মরণে নিজেকে সমর্পণ করতেন তিনি। তাঁর মনিব একরাতে দেখলেন, রাবেয়া নামাজে আছেন এবং ঘরে আলোর কোনো উৎস না থাকা সত্ত্বেও তাঁর চারপাশ উজ্জ্বল। এই অলৌকিক ঘটনার পর মনিব তাঁকে মুক্তি দেন।
২. নিঃস্বার্থ প্রেম ও ঈশ্বরপ্রেমের দর্শন
রাবেয়ার দর্শন ছিল একান্ত প্রেমনির্ভর। তিনি বলতেন:
“আমি আল্লাহকে ভয় থেকে ইবাদত করি না, স্বর্গের আশায়ও না। আমি তাঁকে ভালোবাসি, তাই ইবাদত করি।”
এই প্রেমময় অভিব্যক্তি ইসলামের ইবাদতের গূঢ়তম ব্যাখ্যা। এ এক ‘ইশক-ই-হাকিকি’—যা সুফিদের অন্তরে আলোর মতো জ্বলে। রাবেয়ার প্রেম ছিল নিঃস্বার্থ, পুরস্কার-লালসাহীন এবং নির্ভরশীলতামুক্ত। তিনি বলতেন, “হে আল্লাহ! যদি আমি তোমার ইবাদত করি জান্নাতের আশায়, তবে আমায় জান্নাত থেকে বঞ্চিত করো। আর যদি জাহান্নামের ভয়ে ইবাদত করি, তবে আমায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করো। কিন্তু আমি যদি শুধুই তোমার প্রেমে পড়ে ইবাদত করি, তবে তোমার সৌন্দর্য থেকে আমাকে বঞ্চিত করো না।”
৩. তাপসী জীবন ও আত্মিক সাধনা
রাবেয়ার জীবন ছিল একান্ত নির্জন, পরিশুদ্ধ ও দুনিয়াবিমুখ। তিনি বিয়ে করেননি, সংসারও পাতাননি। নির্জন কুটিরে বাস করতেন, খাদ্য-শয্যা ছিল খুবই অল্প। তিনি দিনে রোজা রাখতেন, রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তাঁর দিন কাটত ধ্যান, ইবাদত ও আত্মসমালোচনায়। তাঁর প্রতিটি নিঃশ্বাসে ছিল “ইয়া আল্লাহ”, তাঁর প্রতিটি সিজদায় ছিল প্রেমের আকুতি।
তিনি বলতেন:
“আমার চোখ দুটি শুধু তারই দর্শনে তৃপ্তি খোঁজে, যার দর্শনে অন্তর দীপ্ত হয়।”
৪. রাবেয়ার সুফি দর্শন: হাকিকত ও মারেফতের পথ
রাবেয়ার ভাবনা ছিল হাকিকতের পথ ধরে আল্লাহর সাথে আত্মিক মিলনের দিকে যাত্রা। তিনি শুধু শরিয়তের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং মারেফতের গভীরে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর কাছে ইবাদতের বাহ্যিকতা নয়, বরং ভেতরের পরিশুদ্ধি ছিল মুখ্য। তিনি এক প্রকার গূঢ় আত্ম-অন্বেষণ পদ্ধতির অনুসারী ছিলেন, যা অনেক পরে সুলতানুল আরেফিন হযরত ইবনে আরাবী (রহ.) এবং রুমি (রহ.)-এর চিন্তাধারায় প্রকাশ পায়।
৫. বাণীগুলো থেকে অন্তর্জাগতিক দীপ্তি
রাবেয়ার বাণীগুলো একেকটি যেন নফসের রক্তাক্ত শরীর থেকে নির্গত রুহানী অশ্রু:
- “হে আমার রব! আমি তোমারই জন্যই আমার সমস্ত হৃদয় দান করেছি; কেবল তোমার প্রেমেই আমি তৃপ্তি পাই।”
- “যদি চোখে অশ্রু না থাকে, তবে অন্তরে প্রেমও থাকে না।”
- “প্রেম কখনো দাবি করে না, বরং দেয়। প্রেম আত্মসমর্পণ, আত্মত্যাগ।”
- “তুমি যদি আল্লাহর প্রেমে পড়ো, তবে তিনি ছাড়া আর কিছুতেই তোমার মন পড়বে না।”
- “আমার কেবল একটিই কামনা – আমি যেন তাঁর প্রেমে দগ্ধ হয়ে হারিয়ে যেতে পারি।”
- “আমি এমন এক প্রেম চেয়েছি যা আমাকে আমার অস্তিত্ব থেকেও মুছে দেয়।”
- “আমার অন্তর তোমার প্রেমের কুয়াশায় মোড়া, হে প্রভু, আমি আর কেউ নই, আমি শুধু তোমার।”
৬. পুরুষ ও সাধুদের চোখে রাবেয়ার মর্যাদা
হযরত হাসান বসরী (রহ.), একজন প্রখ্যাত তাবেঈ ও সুফি সাধক, একবার রাবেয়ার কাছে জ্ঞান নিতে গিয়ে বলেছিলেন:“রাবেয়া, তুমি তো আমাদের চেয়েও অনেক অগ্রগামী প্রেমিকা। তোমার চোখে শুধু আল্লাহর নূর ভাসে।”
তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এমন ছিল, যা অনেক পুরুষ সাধককেও আলোড়িত করত। কেউ কেউ তাঁকে ‘মারইফাতের রানী’, কেউ কেউ ‘ইশকের প্রথম আলোকবর্তিকা’ বলেন।
৭. অলৌকিকতা ও কারামতের ধারা
রাবেয়ার অলৌকিকতা ছিল তাঁর ঈশ্বরপ্রেমে নিমগ্নতায়। কাহিনী আছে, তিনি যখন নামাজ পড়তেন, চারপাশ আলোয় উদ্ভাসিত হতো। একবার একটি পাখি এসে তাঁর পাশে বসে থাকল, সেও যেন ইবাদতের প্রশান্তিতে নিমগ্ন। আবার বলা হয়, তাঁর শুকনো রুটিতে যখন কেউ দুধ দিতে চাইত, তিনি ফিরিয়ে দিতেন – বলতেন, “আমার মালিক আমায় যা দেন, তাতেই তৃপ্ত থাকি।”
৮. রাবেয়ার মৃত্যু ও সুফি উত্তরাধিকার
রাবেয়া বসরীর ইন্তেকাল হয় ৮০১ খ্রিস্টাব্দে। মৃত্যুর আগমুহূর্তেও তাঁর চোখে ছিল আল্লাহর প্রেমের অশ্রু। তাঁকে ইরাকের বসরায় সমাহিত করা হয়। তবে তাঁর প্রেম, তাঁর বাণী, তাঁর সাধনার আলো আজও অম্লান। বিশ্বের নানা প্রান্তে তাঁকে নারী সুফি সাধনার প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়।
উপসংহার
রাবেয়া বসরী শুধু একজন সাধ্বী ছিলেন না, তিনি এক অগ্নিশিখা – প্রেমের, ত্যাগের, নির্লিপ্ততার ও ঈশ্বরচেতনার শিখা। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় কীভাবে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহর প্রেমে হারিয়ে যেতে হয়। আজকের এই ঘূর্ণাবর্ত জীবনের ভেতরেও তাঁর বাণী হৃদয়ে ধারণ করলে আলোর দেখা পাওয়া অসম্ভব নয়। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন, প্রেমই সবচেয়ে পবিত্র ইবাদত, আর আত্মনিবেদনই আল্লাহর দরবারে পৌঁছানোর আসল সেতু।
রাবেয়া বসরীর পথ আমাদের সেই নিঃস্বার্থ প্রেমে ডাকে, যেখানে কোনো ভয় নেই, কোনো চাওয়া নেই, শুধু আছে একান্ত প্রেমের দরিয়া – লা শরিক লাহু।