লেখক – কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
দ্বীনে মুহাম্মদী ও আহলে বাইয়্যেত অবিচ্ছিন্নভাবে আছে। আহলে বাইয়্যেতের মাধ্যম ছাড়া দ্বীনে মুহাম্মদী প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। আর দ্বীনে মুহাম্মদী কায়েম না হলে মানব সুরত ভেঙ্গে জাহান্নামী সুরত নিয়ে দোযখে বাস করতে হবে। শাস্ত্রে বর্ণিত কালাম হলো- অন্যান্য নবীদের অনেক উম্মতের চেহারা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু উম্মতে মুহাম্মদীর সুরত পরিবর্তন বা বিকৃত হবে না। এর কারণ কি? কারণ, যারা উম্মতে মুহাম্মদী তারা মুহাম্মদী দ্বীনকে ধারণ করেছে তথা স্বীয় সত্তায় কায়েম করেছে বিধায় তাদের চেহারা পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ তারা আল্লাহর সুরতে কায়েম হয়ে আছে। “দ্বীনে মুহাম্মদী হলো যে দ্বীনকে ধারণ করলে মানব সুরত কায়েম থাকে।” অর্থাৎ হায়ানী আত্মার জগত থেকে বের হয়ে ইনসানী আত্মাতে কায়েম হয়ে যাওয়া।
দ্বীনে মুহাম্মদীই হলো ইসলাম। এজন্যই বলা হচ্ছে- “ইয়া আইউহাল্লাজিনা আমানুদ্খুলু ফিসসিলমি কাফফাতান” অর্থাৎ- হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণ রূপে দাখেল হও তথা প্রবেশ করো বা ইসলামে কায়েম থাকো (সুরা বাকারা- ২০৮)।
‘মানুষের এক নাম মুহাম্মদ।’ মুহাম্মদের দ্বীনের ভিত্তি হলো মিল্লাতে ইবরাহীম। “মিল্লাতে ইবরাহীম হলো আল্লাহকে দেখে বিশ্বাস করা।” কাজেই যারা আল্লাহর অনুমতি নিয়ে ঈমান আনে নি তারা ঈমানদার নয়, মুসলিম নয়। আর ঈমানদার না হলে দ্বীনে মুহাম্মদীর মধ্যে দাখেল হওয়ার কোনো সিষ্টেম নেই। যারা আল্লাহর অনুমতি নিয়ে ঈমান এনেছে তাদের প্রথম কাজই হলো আগুন বস্তুর নফস আম্মারার ফেলগুলো তথা শয়তানের গুণখাছিয়ত হতে বের হয়ে যাওয়া (সুরা বাকারা- ২০৮)। আগুন বস্তুর আত্মা হায়ানী। পশু আত্মার সিরাতের মাঝে অসংখ্য সুরত নিহিত আছে যারা ঐ সিরাত ধারণ করছে মৃত্যুর পর তাদের মানব সুরতকে পরিবর্তন করে দোযখী সুরতে তথা পশুর সুরতে কায়েম করে দেয়া হবে অর্থাৎ সুরত বদল করে দিবে।
উম্মতে মুহাম্মদীগণ সেই শয়তানের ফেল হতে মুক্ত হওয়ার সাধনায় কামিয়াবী বিধায় উম্মতে মুহাম্মদীগণের সুরত পরিবর্তন হবে না। আল্লাহর সিরাত হতে মানুষের সুরত সৃষ্টি আবার হায়ানী সিরাতের কারণে সুরত বদল হয়ে যাবে তথা আসফালাস্ সাফলিন হবে (সুরা তীন)। সুতরাং বলা যায় যারা হায়ানী আত্মার ফেলগুলো মনের মধ্য হতে দূর করে দিয়ে ইনসানীয়াত কায়েম করেছে বা করার সাধনা করছে একমাত্র তারাই হলো উম্মতে মুহাম্মদী এবং তারাই দ্বীনে মুহাম্মদীতে কায়েম আছে। কারণ, ইসলাম হলো স্বভাব ধর্ম (আল ইসলামু দ্বীনুল ফেৎরাত)।
হায়ানীয়াত হতে ইনসানীয়াতে কায়েম হওয়া মানব ধর্ম তথা ইসলাম বা দ্বীনে মুহাম্মদী। যারা দ্বীনে মুহাম্মদীতে কায়েম আছে তারাই খফির ঘর মুহাম্মদ এবং সে ঘরের বাসিন্দা চারজনকে ধারণ করেছে তথা মানব সুরত কায়েম করেছে তথা আল্লাহর সুরতে কায়েম হয়ে আছে।
কোরানের কালাম হলো “সিফ্গাতাল্লাহ্” অর্থাৎ আল্লাহর রং তথা ঈশ্বরের রং (সুরা বাকারা- ১৩৮)। এ রং হলো আল্লাহর ফেৎরাত বা সিরাত- যা আল্লাহর রহমতপূর্ণ সপ্তগুণ। ইহাই ফেৎরাতে আহসান এবং আল্লাহর ফেৎরাত বা সিরাত হতেই মানুষ সৃষ্টি। আল্লাহর সিরাত আল্লাহরই সুরত প্রকাশ করে। যেহেতু সৃষ্টি মানেই অবিকল প্রকাশ আর মানুষ হলো আল্লাহর সৃষ্টি, কাজেই মানুষ আল্লাহর অবিকল প্রকাশ। ইহাই হলো আহসান সুরত। এই সুরত হেফাজত করাই মানুষের সাধনা। এজন্য কোরানের কালাম হলো- “ফেৎরাতাল্ লাহিল্লাতি ফাতারান্ নাসা আলাইহা” (সুরা রুম- ৩০) অর্থাৎ আল্লাহ যেই প্রকৃতির (ফেৎরাতের) উপর মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন, তা-ই তো তাদের জন্য আল্লাহর একমাত্র ফেৎরাত। আল্লাহর সেই ফেৎরাত হারানোই পাপ আর সেই ফেৎরাত ধারণ করাই হলো পুন্য, ধর্ম। পুণ্যের ফল মানব সুরতে কায়েম থাকা তথা ইল্লিনে বাস করা। ইল্লিন এবং সিজ্জিন মুর্কারাবুন ব্যক্তিগণ দেখতে পাবে (সুরা মুতাফ্ফিফিন- ২১)।
যারা দ্বীনে মুহাম্মদীতে দাখেল হয় নি বা উম্মতে মুহাম্মদী নয় তারা ইল্লিন-সিজ্জিনের পরিচয় পাবে না, শুধু অনুমান-কল্পনায় একটি ধারণা রাখবে। ইল্লিন হলো জান্নাতী জীবন এবং এরাই নগদ বা বর্তমান জান্নাতে বাস করছে (ইয়া আইউহাতুন্নাফসুল মুৎমাইন্নাহ্- সুরা ফজর- ২৭)। মুহাম্মদের সাথেই তার আহলে বাইয়্যেত আলী, ফাতেমা, হাসান এবং হুসাইন কায়েম আছেন- এদেরকে আঁকড়ে থাকাই ধর্ম-কর্ম (সুরা ইমরান- ১০৩)। মুহাম্মদের আহলে বাইয়্যেত ছাড়া সৃষ্টির অস্তিত্ব সম্ভব নয়, আল্লাহর কালাম প্রকাশও সম্ভব নয়। দ্বীনে মুহাম্মদীতে কায়েম না হলে আহলে বাইয়্যেত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে এবং আল্লাহর কালামও নাজিল হবে না বা কালিমুন প্রকাশ হবে না। কারণ, আল্লাহর মতলেক কালাম হুসাইনের জলিতে প্রতিঘাত হয়ে নাতেক হচ্ছে।
মানব সুরতকে কায়েম করতে না পারলে মানুষ প্রথমেই যা হারাবে তা হলো আল্লাহর কালাম বা বাকশক্তি তথা স্বরসতী মানুষের সাথে থাকবে না তথা স্বরসতী উঠে যাবে। মুহাম্মদ হতে হুসাইন এবং হুসাইন আছেন মুহাম্মদী সুরতে। শেষে মুহাম্মদ-হুসাইন এক অজুদ। এজন্যই রাছুলের কালাম হলো- “হুসাইন মিন্নি ওয়া আনা মিনাল হুসাইন” অর্থাৎ হুসাইন আমা হতে এবং আমি হুসাইন হতে। প্রথম মুহাম্মদ হতে হুসাইন পরে হুসাইন হতে মুহাম্মদ। মুহাম্মদ এবং হুসাইনের অপূর্ব মিলন ঘটে মানুষ মোহনায় এসে এবং সেই পাক মানুষে আল্লাহর কালাম জারি আছে। আল্লাহপাক যা দেখতে চেয়েছেন মুহাম্মদের (সাঃ)-এর মাঝে তা দেখার সাথে সাথে নবুয়ত খতম করলেন তথা সৃষ্টির বিবর্তন থেমে গেলো।
হাদিসের কালাম হলো- রাছুল (সাঃ) দু’টি জিনিস রেখেছেন। এক আল্লাহর কালাম- যা কোরান, দ্বিতীয়ত তার পবিত্র আহলে বাইয়্যেত। এরা কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না (মেশকাত- ৫৮৯২-৯৩ নম্বর হাদিস) এবং তা চিরবর্তমান। যারা কোরান আর সুন্নাহ্ বুঝাচ্ছে তারা দ্বীনে মুহাম্মদীর লোক তথা উম্মতে মুহাম্মদী নয়। এরা কোরান থেকে আহলে বাইয়্যেতকে আলাদা করছে তথা খন্ডন করছে। অন্ধ-মূর্খরা বুঝে নি কোরান আর আহলে বাইয়্যেত অবিচ্ছিন্ন অবস্থায় চিরবর্তমানে বিদ্যমান। যারা কোরান খন্ডন করেছে তারা আহলে বাইয়্যেত হতে বিচ্ছন্ন হয়ে গেছে এবং এর পরিণাম হলো দোযখ ভোগ করার জন্য কর্ম লেবাস বদল হয়ে যাবে। যারা আল্লাহর কালামের খন্ডন করেছে তারাই আল্লাহর কৌফিয়তের সম্মুখীন হবে তথা দোযখগামী হবে (সুরা হিজর- ৯৭)।
এই কোরান নবীর আহলে বাইয়্যেত যোগে নাজিল হচ্ছে। এই কোরান কাগজে থাকে না। ইহা আল্লাহর নাজিলকৃত নুরী কোরান তথা আরবী কোরান (সুরা জুখরুফ- ৩)। আর কাগজে লিখিত কোরান- যা কিসসা কোরান বলে বিধৃত আছে তা আল্লাহপাক নিজেই খন্ড খন্ড করে তেইশ বৎসরে নাজিল করেছেন (সুরা দাহর- ২৩)। সুতরাং কোরান খন্ড করা মানে আহলে বাইয়্যেত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তথা নিজেকে হারিয়ে ফেলা বা দোযখে নিক্ষেপ করা। কাজেই যে মানুষ দোযখী হবে তার কর্ম লেবাস বদলের কারণে আল্লাহর পাক কালাম তথা আল্লাহু কালিমুন উঠে যাবে। যার দীলে আল্লাহর কালাম আছে সে কখনো দোযখে যাবে না।
এটা মাদ্রাসা হতে কোরান মুখস্তকারী নয়, যাদেরকে তথাকথিত মুসলিম সমাজ কোরানে হাফেজ বলে জানে। এই ধরণের আড়াইশত কোরানে হাফেজ (মুখস্তকারী) ইয়াজিদের দলেও ছিল। এখন আছে লক্ষ লক্ষ। তারা মুসলমান কি না, জারজ কি না (হায়ানী আত্মার অধিকারী) তা জানা বুঝা দরকার। আরবী কোরান আল্লাহপাক নিজেই শিক্ষা দেন (সুরা রহমান)। এই কোরান কোনো মাদ্রাসায় শিক্ষা দেয়া হয় না, তারা এই কোরানের খবরও জানে না। “ফী কিতাবুম্ মাকনুনিন” এর মধ্যে সাতটি নুরের ফলকে ঐ কিতাব লিপিবদ্ধ আছে। যারা পবিত্র তারা ব্যতীত ঐ কিতাব কেহ পাঠ করতে পারে না, স্পর্শও করতে পারবে না (ওয়াকিয়া- ৭৯)। নবীর আহলে বাইয়্যেত যোগে ঐ কিতাব নাজিল হচ্ছে। “নাজিল হচ্ছে নূরী সাত অক্ষরে আর তা লেখা হচ্ছে নুরী তিরিশ অক্ষরে।” আল্লাহ যাকে কোরান শিক্ষা দেন তখন তাঁর সে বান্দা আল্লাহকে চিনতে পারে এবং একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করে, সেজদা করে। চোখ খুলে দেখো রব রহমান আল্লাহ কিভাবে তার বান্দাদেরকে তাঁর পাক কালাম শুনাচ্ছেন। সে কালাম শ্রবণে ঈমানদারগণ খাঁটি ইনসানে পরিণত হচ্ছেন (সুরা রহমান- ৩)।
আল্লাহর সে বান্দাগণই একমাত্র বলতে পারেন- “ইয়্যাকানাবুদু ওয়া ইয়্যাকানাস্তায়িনু।” অর্থাৎ আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং একমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থণা করি (সুরা ফাতেহা- ৪)। ইয়াজিদ আল্লাহর এ কালাম শুনতে পাবে না, বরং সে এ কালামের অস্বীকারকারী হবে। কারণ, সে আহলে বাইয়্যেত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যারা আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে ঈমান এনেছে (সুরা ইউনুছ- ১০০) তারাই দ্বীনে মুহাম্মদীতে দাখেল হয়েছে, যারা দ্বীনে মুহাম্মদীতে দাখেল হয়েছে তারাই আহলে বাইয়্যেতকে ধারণ করে মুক্তি লাভ করছে। যারা আহলে বাইয়্যেত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তারা আল্লাহর কালাম কোরান শ্রবণ করতে পারবে না। যারা আল্লাহর কালামের শ্রবণ হতে দূরে থাকবে তারা অবশ্যই দোযখগামী হবে। সুতরাং মানব জাতির মুক্তির জন্য মুহাম্মদ (সাঃ) এবং তাঁর পাক আহলে বাইয়্যেতকে ধারণ করতেই হবে। দ্বীনে মুহাম্মদী তথা ইসলামই একমাত্র মানব মুক্তির ধর্ম।
এই ইসলাম গন্ডীভূত কোনো ধর্ম নয়, ইহা মানব জাতির মুক্তির বিধান। রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, ঈসা, মুসা যতো আছে সবার অস্তিত্বে এক মুহাম্মদই আছে এবং এক মুহাম্মদকে ধারণ করেই এই মানব মুক্তির বিধান তথা দ্বীনে মুহাম্মদী প্রচার করছে। প্রত্যেক মানুষের সাথেই পবিত্র আহলে বাইয়্যেত জড়িত আছে।
তারা দ্বীনে মুহাম্মদীতে কায়েম হয়েই মানবরূপে প্রেরিত বা অবতার হচ্ছে। একই পবিত্র সত্তার প্রবাহিত রূপ এরা। পাক মানুষ তথা প্রেরিত বা অবতার বহু হয়ে এক অখন্ডকালে স্থিত হয়ে আছে। প্রেরিত বা অবতার যারা তারা এখন-তখন নয় তারা অখন্ডকালে স্থিত আছে, যুগে যুগেই তারা বর্তমান। তারা বহু হয়েও এক হয়ে অখন্ডকালে অবস্থান করছে। অখন্ডকালে স্থিত হচ্ছে আহলে বাইয়্যেতকে ধারণ করেই। অন্ধ-মূর্খদের দ্বারা যুগে যুগে ধর্ম এবং ধর্ম শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে তথা মুতাশাবেহাত বা রূপক-কাঠামো দ্বারা ধর্ম প্রচার করা হয়েছে, ধর্ম কিতাবের মুহকামাত বুঝে নি। মুহকামাত বুঝলে দ্বন্দ্ব নিরসন হতো, ঐক্যতায় পৌঁছতে পারতো। মুহকামাত না বুঝার ফলে ধর্ম বিভক্ত হচ্ছে এবং ধর্মশাস্ত্র জাতি-গোত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ হচ্ছে এবং শত শত দল উপদলে মানুষ বিভক্ত হয়ে শেষে ধর্মের নামে অত্যাচার-নির্যাতন, ফতোয়াবাজি, মানুষ হত্যা চালাচ্ছে।